শুকরের গোশত খাওয়া উচিত নয় কেন – বৈজ্ঞানিক কারণ

 


শুকরের গোশত খাওয়া উচিত নয় কেন – বৈজ্ঞানিক কারণ

 

লিখেছেনঃ ড খন্দকার আব্দুল মান্নান

 

মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহপাক শুকরের গোশত খাওয়াকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ধর্মীয় নির্দেশ সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য নয় বলে একথা বাদই দিলাম। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষনায় শুকরের গোশত খাওয়াকে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে সনাক্ত করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনুল করীম মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ এবং জীবন পরিচালনার একমাত্র সংবিধান। এই মহাগ্রন্থে সূরা বাকারা, আয়াত ১৭৩; সূরা আনয়াম, আয়াত ১৪৫; সূরা মায়েদা, আয়াত ৩; সূরা নাহল, আয়াত ১১৫ ইত্যাদি। স্থানে ‘আল্লাহ রাব্বল আলামীন’ আনুষাঙ্গিক কিছু নির্দেশের সাথে শুকরের গোশত খাওয়াকেও হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। শুকর নাপাক জন্তু। দেখতেও বিসখুটে। কোন সুস্থ রুচিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এদের বহিরাকৃতি, অবয়ব ও আচরণ দেখে এদের গোশত খাওয়ার প্রতি কোন আকর্ষণ থাকতে পারে না। ময়লা আবর্জনার মধ্যে শুকরের বিচরণ এবং সর্ব প্রকার ময়লা আবর্জনা ও মানুষের পায়খানা হল শুকরের অতি লোভনীয় খাদ্য।

বর্তমান শতাব্দী হল বৈজ্ঞানিক যুগ। মানুষের জীবনযাত্রা বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে পড়েছে। আজ বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। একথা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য। খাদ্ৰ-দ্রব্যের গুণাগুণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা নির্ধারণ করে এদের ভাল-মন্দ সব দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, শুকরের গোশত খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষতিকর। প্রকৃতপক্ষে বিগত বছরগুলোতে বৈজ্ঞানিকগণ এই ক্ষতিকর বস্তুটি খাওয়ার বিরুদ্ধে মানুষকে সতর্ক করে আসছেন। এটা খাওয়া ক্ষতিকর কেন? কি কি ক্ষতিকর জিনিষ আছে শুকরের গােশতে? দেখা যাক………।

প্যারাসাইট

(ক) ট্রাইকিনেলা স্পাইরালিস (পর্ক ওয়ার্ম) ইহা অত্যন্ত সাধারণ এক জাতীয় প্যারাসাইট যা শুকরের মাংশ থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এই প্যারাসাইট দ্বারা আক্রান্ত হলে যে ব্যাধির সৃষ্টি হয় তাকে ‘ট্রাইকিনসিস’ বলা হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে শরীরের ‘ভাইটাল অরগ্যানগুললো নষ্ট হয়ে যায় এবং হঠাৎ করে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, একমাত্র যুক্তরাজ্যেই ২০ মিলিয়ন ‘ট্রাইকিনসিস’ রোগী আছে। স্মরণযোগ্য যে, শুকরের গোশত খেলেই যে একমাত্র এ রোগ ছড়ায় তা নয়। পৃথিবীর একটি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়েছে যে, এক ব্যক্তি হাত দিয়ে সংক্রামিত শুকরের গোশত নাড়াচাড়া করেছিলো। তার বেশ কিছুদিন পর সে হাতের নখ মুখে দেয়ার ফলে ট্রাইকিনসাস’ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

(খ) আরও অনেক প্যারাসাইটের মধ্যে টিনিয়া সোলিয়াম’ (পর্ক টেপওয়ার্ম) হলো একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্যারাসাইট। ইহা সাধারণভাবে শরীরের মাংসপেশী, হৃৎপিন্ড, মস্তিস্ক, চোখ,স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি আক্রান্ত করে মারাত্মক উপসর্গের সৃষ্টি করে। বর্তমান বিশ্বে পর্ক টেপওয়ার্মে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬০ মিলিয়নেরও বেশী। এদের অধিকাংশই শুকরের টেপওয়ার্ম দ্বারা আক্রান্ত।

সাটক্সিন

বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা অতি সম্প্রতি সাটক্সিন নামক এক ধরনের নতুন প্রোটিন (আমিষ) শুকরের গোশত থেকে আবিস্কৃত হয়েছে। চামড়ার বিভিন্ন প্রকার এ্যালার্জি, এ্যাকজিমা, হাঁপানী ইত্যাদি রোগের জন্য এই নব। আবিস্কৃত প্রোটিন দায়ী। দেখা গেছে যে, অত্যন্ত স্বল্প মাত্রায় ‘সাটক্সিন খেলেও শারিরীক অসারতা এবং গ্রন্থিতে ব্যাথার সৃষ্টি করতে পারে।

মিউকোপলিস্যাকারাইডস

শুকরের গোশতের মধ্যে মিউকোপলিস্যাকারাইডস মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে বিদ্যমান থাকায় ইহা ভক্ষণে শরীরের গ্রন্থিসমূহে বিভিন্ন প্রকার রোগের সৃষ্টি করে।

জৈব স্নেহ

ইহা বিজ্ঞানসম্মত একটি বাস্তব সত্য যে, শুকরের গোশতের মধ্যে স্নেহ জাতীয় পদার্থের আধিক্য মানুষের শারিরীক স্থূলতা, এথেরোস্কেলেরোসিস টু ইত্যাদির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ। জীবদেহে দুই ধরনের চর্বি থাকেঃ

১। যে চর্বি গোশতের বহির্ভাগের বিদ্যমান থেকে গোশতকে ঢেকে দু রাখে। এই ধরনের চর্বি সহজেই গোশত থেকে আলাদা করা যায়।

২। যে চর্বি গোশতের আঁশের মধ্যে মিশে ঘনীভূত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে।

আমাদের অনেকেরই ধারণা যে, গোশতের বহির্ভাগে বিদ্যমান চর্বিকে সরিয়ে নিলেই গোশত চর্বিমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু গোশতের আঁশের সাথে যে চর্বি ঘনীভূত অবস্থায় মিশে আছে, সেগুলো সম্পর্কে সজাগ থাকার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনেকেই অনুভব করি না। আর এই চর্বি আদৌ গোশত থেকে বের করে ফেলা সম্ভব নয়। সাধারণভাবে ব্যবহৃত বিভিন্ন গোশতের মধ্যে চর্বির উপস্থিতি নিন্মরূপঃ

§  বাছুরের গোশত (Veal)—————-১০%

§  খাসী/ভেড়ার গোশত (Mutton)——–২০%,

§  মেষশাবকের গোশত (Lamb)———-২৩%

§  শুকরের গোশত (Pork)—————৩৫%

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই যে, যখন কোন তৃণগোজী প্রাণী যেমন গরু ছাগল বা ভেড়ার গোশত চর্বি সহকারে খাওয়া হয়, তখন ঐ চর্বি শরীরের ভিতরে অধিকতর সহজভাবে রক্তপ্রবাহের সাথে মিশে গিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু শুকরকে যেহেতু ময়লা-আবর্জনা খাওয়ানো হয়, তাই শুকরের গোশত এবং চর্বি সহজে পরিপাক হয় না। এবং চর্বিও সহজে শক্তিতে রূপান্তরিত হয় না। এটা রক্তপ্রবাহের মধ্যেই থেকে যায়। রক্তপ্রবাহের মধ্যে এই চর্বি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে বিদ্যমান থাকে বলে ইহা হৃৎপিণ্ডের ব্যাধি, অকাল বার্ধক্য, বার্ধক্যজনিত কারণে শারিরীক অসুস্থতার তীব্রতা এবং প্যারালাইসিসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গ্রোথ (Growth) হরমোন

গ্রোথ হরমোনের মাত্রা শুকরের গোশতের মধ্যে খুব বেশী থাকে বিধায় নিয়মিত এক নাগাড়ে শুকরের গোশত খেলে শরীরের স্বাভাবিক বর্ধন এবং আকৃতিতে ব্যাঘাত দেখা দেয়। আধুনিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং গবেষণা যা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, শুকরের গোশতের চর্বি শুকরের পেট এবং নিতম্বে বেশী পরিমাণে বিদ্যমান থাকে, বিধায় শুকরের গোশত যারা খায়, ঐ চর্বি তাদের শরীরে গিয়ে পেটে এবং নিতম্বে জমা হতে থাকে। যার ফলে। শরীর ধীরে ধীরে ‘ষ্টোভ’ এর আকার ধারণ করে।

যৌন অক্ষমতা

শুকরের গোশতে অতি উচ্চ মাত্রায় চর্বি থাকে বলে নিয়মিত শুকরের গোশত খেলে শরীরে ভিটামিন ই (E) এর ঘাটতি দেখা দেয় এবং এই ঘাটতি যৌন-গ্রন্থিসমূহের স্বাভাবিক ক্রিয়ায় বিশেষ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ফলে যৌন দুর্বলতা এবং যৌন অক্ষমতা দেখা দেয়।

ভিটামিন ‘ই’-এর অভাবে ক্রমান্বয়ে ভিটামিন ‘এ’ -এর অভাব দেখা দেয়। ভিটামিন ‘এ’ -এর অভাবে নানা প্রকার চর্ম রোগ এবং চোখের অসুখ হয়।

শুকরের গোশত’ না ‘বিষ?

ময়লা আবর্জনা ভক্ষনে অভ্যস্ত শুকরের স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশী থাকে। ফলে এদের লিম্ফ্যাটিক সিষ্টেম (Lymphatic system) রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সর্বদা চাপের মুখে থাকে। এই লিম্ফ্যাটিক সিষ্টেম কর্তৃক উৎপাদিত রোগ প্রতিরোধক বস্তুগুলো শুকরকে রোগ থেকে রক্ষা করে; কিন্তু শুকরের রোশত ভক্ষনকারীদের শরীরে বিষের মত কাজ করে। এর ফলে শুকরের গোশত ভক্ষণকারীদের শরীরে চর্মরোগ ও নানা প্রকার জটিল রোগের সৃষ্টি হয়।

বিশ্বাস করুন আর নাই করুন।

বিশ্বের বহু পণ্ডিত ব্যক্তি এই মত পোষণ করেন যে, শুকরের গোশত খেলে মানুষ যৌন ক্ষুধার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, শুকরই একমাত্র প্রাণী যা তার সাথী সম্পর্কে যৌন ক্ষুধার তাড়না বা ঈর্ষাভাব পোষণ করে না। আরও কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন যাঁরা মনে করেন যে, অনবরত রের গোশত খেতে থাকলে মানুষ লজ্জা-শরম হারিয়ে ফেলে।

সূত্র

i) G.J. Tortora B.R. Funke C.L. case. Microbiology. The Benjamin Cummings Pub. C. Inc. 1992, P.643.

ii) The New Illusted Medical and Health Encyclopedia, P.1362.

iii) Dr. Haluk Nurbaki “Verses From the Glorious koran and the facts of Science.”

 

 

No comments

Powered by Blogger.