হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি পাঠ - ০১
হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা
হাদীস (حَدِيْث) এর শাব্দিক অর্থ:
নতুন, প্রাচীন ও পুরাতন এর বিপরীত বিষয়। এ অর্থে যে সব কথা, কাজ ও বস্ত্ত পূর্বে ছিল না, এখন অস্তিত্ব লাভ করেছে তাই হাদীস। এর আরেক অর্থ হলো: কথা।
ফক্বীহগণের পরিভাষায় নাবী কারীম
(ﷺ) আল্লাহ্র
রাসূল হিসেবে যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন
এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদীস বলা
হয়।
১। ক্বওলী হাদীস:
কোন বিষয়ে রাসুলুল্লাহ
(ﷺ) যা বলেছেন, অর্থাৎ যে
হাদীসে তাঁর কোন কথা বিবৃত হয়েছে তাকে ক্বওলী (বাণী সম্পর্কিত) হাদীস বলা হয়।
২। ফে’লী হাদীস:
মহানাবী (ﷺ)-এর
কাজকর্ম,
চরিত্র ও আচার-আচরণের ভেতর দিয়েই ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান ও রীতিনীতি
প্রস্ফুটিত হয়েছে।
অতএব
যে হাদীসে তাঁর কোন কাজের বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে তাকে ফে’লী (কর্ম সম্পর্কিত)
হাদীস বলা হয়।
৩। তাকরীরী হাদীস:
সাহাবীগণের যে সব কথা বা কাজ নাবী কারীম (ﷺ)-এর অনুমোদন ও সমর্থন প্রাপ্ত হয়েছে, সে ধরনের কোন কথা বা কাজের বিবরণ হতেও শরীয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায়।সুন্নাহ (السنة):
হাদীসের
অপর নাম সুন্নাহ্ (السنة) সুন্নাত
শব্দের অর্থ চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। যে পন্থা ও
রীতি নাবী কারীম (ﷺ) অবলম্বন
করতেন তাকে সুন্নাত বলা হয়।
খবর (خبر):
হাদীসকে আরবী ভাষায় খবরও (خبر) বলা হয়। তবে খবর শব্দটি হাদীস ও ইতিহাস উভয়টিকেই বুঝায়।
আসার (أثر ):
আসার শব্দটিও কখনও কখনও রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর হাদীসকে নির্দেশ করে।
কিন্তু অনেকেই হাদীস ও আসার এর মধ্যে
কিছু পার্থক্য করে থাকেন। তাঁদের মতে- সাহাবীগণ থেকে শরীয়াত সম্পর্কে যা কিছু
উদ্ধৃত হয়েছে তাকে আসার বলে।
ইলমে হাদীসের কতিপয় পরিভাষা
সাহাবী (صحابى):
যিনি ঈমানের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহচর্য লাভ করেছেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবী বলা হয়।তাবেঈ (تابعى) :
যিনি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোন সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষ তাঁকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে তাবেঈ বলা হয়।তাবে-তাবেঈ (تابعى تابع) :
যিনি কোন তাবেঈ এর নিকট হাদীস
শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষ তাঁকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন
তাঁকে তাবে-তাবেঈ বলা হয়।
মুহাদ্দিস (محدث) :
যিনি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু
সংখ্যক হাদীসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাঁকে মুহাদ্দিস বলা হয়।
শাইখ (شيخ) :
হাদীসের শিক্ষাদাতা রাবীকে শায়খ বলা হয়।শাইখান (شيخان) :
সাহাবীগনের মধ্যে আবূ বকর (রা.)
ও উমর (রা.)- কে একত্রে শাইখান বলা হয়। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রে ইমাম বুখারী
(রাহি.) ও ইমাম মুসলিম (রাহি.)-কে এবং ফিক্বহ-এর পরিভাষায় ইমাম আবূ হানীফা
(রাহি.) ও আবূ ইউসুফ (রাহি.)-কে একত্রে শাইখান বলা হয়।
হাফিয (حافظ) :
যিনি সনদ ও মতনের বৃত্তান্ত সহ
এক লাখ হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাঁকে হাফিয বলা হয়।
হুজ্জাত (حجة) :
অনুরূপভাবে যিনি তিন লক্ষ হাদীস
আয়ত্ত করেছেন তাঁকে হুজ্জাত বলা হয়।
হাকিম (حاكم) :
যিনি সব হাদীস আয়ত্ত করেছেন
তাকে হাকিম বলা হয়।
রিজাল (رجال) :
হাদীসের রাবী সমষ্টিকে রিজাল
বলে। যে শাস্ত্রে রাবীগণের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে আসমাউর-রিজাল বলা হয়।
রিওয়ায়াত (رواية):
অন্য কথায় রাসুলুল্লাহ (ﷺ)
প্রচারিত উচ্চতম আদর্শই সুন্নাত।
হাদীস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত
বলে। কখনও কখনও মূল হাদীসকেও রিওয়ায়াত বলা হয়।
যেমন- এই কথার সমর্থনে একটি রিওয়ায়াত (হাদীস)
আছে।
সনদ (سند):
হাদীসের মূল কথাটুকু যে সূত্র
পরম্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে সনদ বলা হয়।
এতে হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম
একের পর এক সজ্জিত থাকে।
মতন (متن):
হাদীসে মূল কথা ও তার শব্দ সমষ্টিকে মতন বলে।মাওকূফ (موقوف) :
যে হাদীসের বর্ণনা- সূত্র ঊর্ধ্ব দিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে , অর্থাৎ যে সনদ -সূত্রে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাওকূফ হাদীস বলে। এর অপর নাম আসার।মাকতূ (مقطوع):
যে হাদীসের সনদ কোন তাবেঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মাকতূ হাদীস বলা হয়।তা’লীক (تعليق):
কোন কোন গ্রন্থকার হাদীসের পূর্ণ সনদ বাদ দিয়ে কেবল মূল হাদীস বর্ণনা করেছেন। এরূপ করাকে তা’লীক বলা হয়।মুদাল্লাস (مدلس):
যে হাদীসের রাবী নিজের প্রকৃত শাইখের (উস্তাদের) নাম উল্লেখ না করে তার উপরস্থ শাইখের নামে এভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে মনে হয় যে, তিনি নিজেই উপরস্থ শাইখের নিকট তা শুনেছেন অথচ তিনি তাঁর নিকট সেই হাদীস শুনেন নি- সে হাদীসকে মুদাল্লাস হাদীস এবং এইরূপ করাকে ‘তাদ্লীস’ আর যিনি এইরূপ করেন তাকে মুদাল্লীস বলা হয়।মুযতারাব (مضطرب):
যে হাদীসের রাবী হাদীসের মতন ও সনদকে বিভিন্ন প্রকারে বর্ণনা করেছেন সে হাদীসকে হাদীসে মুযতারাব বলা হয়। যে পর্যন্ত না এর কোনরূপ সমন্বয় সাধন সম্ভবপর হয়, সে পর্যন্ত এই হাদীসের ব্যাপারে অপেক্ষা করতে হবে অর্থাৎ এই ধরনের রিওয়ায়াত প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।মুত্তাসিল (متصل):
যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষত আছে, কোন স্তরেই কোন রাবীর নাম বাদ পড়ে নি তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে।মুনকাতি (منقطع):
যে হাদীসের সনদে ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, মাঝখানে কোন এক স্তরে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুনকাতি হাদীস, আর এই বাদ পড়াকে ইনকিতা বলা হয়।মুরসাল (مرسل):
যে হাদীসের সনদে ইনকিতা শেষের দিকে হয়েছে, অর্থাৎ সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে এবং তাবেঈ সরাসরি রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর উল্লেখ করে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাকে মুরসাল হাদীস বলা হয়।মু’আল্লাক ( معلق ) :
সনদের ইনকিতা প্রথম দিকে হলে, অর্থাৎ সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়লে তাকে মু’আল্লাক হাদীস বলা হয়।মু‘দাল (معضل):
যে হাদীসে দুই বা ততোধিক রাবী ক্রমান্বয়ে সনদ থেকে বাদ পড়েছে তাকে মু‘দাল হাদীস বলে।মা‘রূফ ও মুনকার (معروف و منكر):
কোন দুর্বল রাবীর বর্ণিত হাদীস অপর কোন মাকবূল (গ্রহণযোগ্য) রাবীর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী হলে তাকে মুনকার বলা হয় এবং মাকবূল রাবীর হাদীসকে মা‘রূফ বলা হয়।সহীহ (صحيح) :
যে মুত্তাসিল হাদীসের সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ আদালত ও যাবত (ধারণ ক্ষমতা) গুণ সম্পন্ন এবং হাদীসটি যাবতীয় দোষত্রুটি ও শায মুক্ত তাকে সহীহ হাদীস বলে।হাসান (حسن) :
যে হাদীসের মধ্যে রাবীর যাবত (ধারণ ক্ষমতা) এর গুণ ব্যতীত সহীহ হাদীসের সমস্ত শর্তই পরিপূর্ণ রয়েছে তাকে হাসান হাদীস বলা হয়। ফক্বীহগণ সাধারণত সহীহ ও হাসান হাদীসের ভিত্তিতে শরীয়াতের বিধান নির্ধারণ করেন।যঈফ (ضعيف ) :
যে হাদীসের রাবী কোন হাসান হাদীসের রাবীর গুণসম্পন্ন নন তাকে যঈফ হাদীস বলে।রাবীর সংখ্যা বিচারে হাদীস প্রধানত দু‘প্রকার।
যথা: ১. মুতওয়াতির (متواتر) ও ২. আহাদ (أحاد)
১. মুতওয়াতির (متواتر):
বৃহৎ সংখ্যক রাবীর বর্ণিত হাদীস, মিথ্যার ব্যাপারে যাদের উপর একাট্টা হওয়া অসম্ভব, সনদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ সংখ্যা বিদ্যমান থাকলে হাদীসকে মুতওয়াতির (متواتر) বলা হয়।২. আহাদ (أحاد): أحاد তিন প্রকার। যথা:
মাশহুর (مشهور):
যে কোন স্তরে হাদীস বর্ণনা কারীর সংখ্যা যদি দুই এর অধিক হয়, কিন্তু মুতওয়াতির এর পর্যায়ে পৌঁছে না তাকে মাশহুর (مشهور) বলে।আযীয (عزيز):
যে কোন স্তরে হাদীস বর্ণনা কারীর সংখ্যা যদি দু‘জন হয় ।গরীব (غريب):
যে কোন স্তরে হাদীস বর্ণনা কারীর সংখ্যা যদি এক জন হয় ।শায (شاذ):
একাধিক নির্ভরযোগ্য রাবীর বিপরীত একজন নির্ভরযোগ্য রাবীর বর্ণনাকে শায হাদীস বলে।কিয়াস (قياس):
অর্থ অনুমান, পরিমাপ, তুলনা ইত্যাদি। পরিভাষায়: শাখাকে মূলের সঙ্গে তুলনা করা, যার ফলে শাখা ও মূল একই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।তাক্বলীদ (تقليد):
দলীল উল্লেখ ছাড়াই কোন ব্যক্তির মতামতকে গ্রহণ করা।ইজতিহাদ (اجتهاد):
উদ্দিষ্ট জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টা চালানোকে ইজতিহাদ বলে।শরীয়াত (شريعة):
অর্থ: আইন, বিধান, পথ, পন্থা ইত্যাদি। পরিভাষায়: মহান আল্লাহ্ স্বীয় দ্বীন হতে বান্দার জন্য যা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন তাকে শরীয়াত বলে।মাযহাব (مذهب):
অর্থ- মত, পথ, মতবাদ ইত্যাদি। ফিক্বহী পরিভাষায়: ইবাদাত ও মু‘আমালাতের ক্ষেত্রে শারঈ হুকুম পালনের জন্য বান্দা যে পথ অনুসরণ করে এবং প্রত্যেক দলের জন্য একজন ইমামের উপর অথবা ইমামের ওসীয়ত কিংবা ইমামের প্রতিনিধির উপর নির্ভর করে তাকে মাযহাব বলে।নাযর (نذر):
কোন বিষয়ে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য চিন্তা-ভাবনা করাকে নাযর বলে।আম (عام):
সীমাবদ্ধ করা ছাড়াই যা দুই বা ততোধিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে তাকে আম বলে।খাস (خاص):
আম এর বিপরীত, যা নির্দিষ্ট বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে।ইজমা (اجماع):
কোন এক যুগে আলিমদের কোন শারঈ বিষয়ের উপর এক মত পোষণ করাকে ইজমা বলে।মুসনাদ (مسند):
যার সনদগুলো পরস্পর এমনভাবে মিলিত যে, প্রত্যেকের বর্ণনা সুস্পষ্ট।ফিক্বহ (فقه):
ইজতিহাদ বা গবেষণার পদ্ধতিতে শারঈ হুকুম সম্পর্কে জানার বিধানকে ফিক্বহ বলে।আসল বা মূল (اصل):
এমন প্রথম বিষয়, যার উপর ভিত্তি করে কোন কিছু গড়ে উঠে। যেমন- দেয়ালের ভিত্তি।ফারা বা শাখা (فرع):
আসলের বিপরীত যা কোন ভিত্তির উপর গড়ে উঠে।ওয়াজিব (واجب):
যা আমল করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর পরিত্যাগ করলে শাস্তি পাওয়া যাবে।মানদূব (مندوب):
যা আমল করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর পরিত্যাগ করলে শাস্তি হবে না।মাহযূর (محظور):
যা পরিত্যাগ করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর আমল করলে শাস্তি পাওয়া যাবে।মাকরূহ (مكروه):
যা পরিত্যাগ করলে সাওয়াব পাওয়া
যাবে আর আমল করলে শাস্তি হবে না।
ফাৎওয়া (فتوى):
জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির নিকট থেকে দলীল ভিত্তিক শারঈ হুকুম সুস্পষ্ট বর্ণনা করে নেয়াকে ফাৎওয়া বলে।নাসিখ (ناسخ):
পরিবর্তিত শারঈ দলীল যা পূববর্তী শারঈ হুকুমকে রহিত করে দেয় তাকে নাসিখ বলে।মানসূখ (منسوخ):
আর যে হুকুমটি রহিত হয়ে যায় সেটাই মানসূখ।মুতলাক্ব (مطلق):
যা প্রকৃতিগত দিক থেকে জাতির সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে কিন্তু অনির্দিষ্টভাবে একটি অর্থকে বুঝায়।মুকাইয়্যাদ (مقيد):
যা মুতলাক্বের বিপরীত অর্থাৎ জাতির সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে না। বরং নির্দিষ্ট একটি অর্থকে বুঝায়।হাক্বীকাত (حقيقة):
শব্দকে আসল অর্থে ব্যবহার করাকে
হাক্বীকত বলে। যেমন- সিংহ শব্দটি এক প্রজাতির হিংস্র প্রাণীকে বুঝায়।
No comments
Post a Comment