অহংকার মানব জীবনের ভয়ংকর বিষয়
অহংকার মানব জীবনের ভয়ংকর বিষয়!
ভূমিকা:
মানবদেহে ষড়রিপু হ’ল কাম,
ক্রোধ, লোভ, মোহ,
মদ ও মাৎসর্য। এর মধ্যে ‘মদ’ হ’ল হিংসা, গর্ব ও অহংকার। জীবনে চলার পথে ষড়রিপু আমাদের সার্বক্ষণিক সাথী। এগুলি ডাক্তারের আলমারিতে রক্ষিত ‘পয়জন’ (Poison)-এর বোতলের মত। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ৬টি আগুনের মধ্যে ‘মদ’ বা হিংসা ও অহংকারের স্ফুলিঙ্গ একবার জ্বলে উঠলে ও তা নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানব গাড়ীটাকে পুড়িয়ে ছারখার করে। এমনকি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেয়।
আধুনিক বিশ্বে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং জাপানের ‘হিরোশিমা’ ও ‘নাগাসাকি’-র ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াও সর্বসাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ যার বাস্তব প্রমাণ।
পরিচয়:
অহংকার আরবি ‘কিবরু’র প্রতিশব্দ। হাদিসের পরিভাষায় অহংকার হলো- ‘সত্যকে অস্বীকার করা;
মানুষকে হেয় করা।’ নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় জানা এবং অন্যকে তুচ্ছ-নিকৃষ্ট মনে করাই অহংকার।
ইমাম যুবাইদি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘অহংকার হলো নিজেকে বড় মনে করা,
নিজের ভালো গুণে প্রীত হওয়া, অন্য মানুষকে নীচ ও ছোট মনে করা,
যাদের প্রতি বিনয়ী হওয়া দরকার তাদের চেয়ে নিজকে উঁচু মনে করাই অহংকার।
অহংকারীর ধরন
নিজেকে বড় ভেবে অনেকে মনের অজান্তেও অহংকারী হয়ে ওঠে। আবার অনেক সময় কিছু কথা ও ভাব এভাবে ফুটে ওঠে-
অহংকারের ধরন তিনটি
১. অন্তরে অহংকার পোষণ করা।
২. চালচলন ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অহংকার প্রকাশ করা।
৩. কথাবার্তায় অহংকার প্রকাশ করা।
মানুষ বংশ, সম্পদ, সৌন্দর্য, শক্তি, সামর্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে অহংকার করে থাকে। যেমন ধনী ও সম্পদশালীর মধ্যে অর্থের গৌরব, স্ত্রীলোকদের মধ্যে সৌন্দর্যের বড়াই এবং ক্ষমতাবানদের মধ্যে ক্ষমতার দম্ভ, বিদ্বান লোকদের মধ্যে বিদ্যার গর্ব ইত্যাদি।
অহংকারীর ধরন:
১. যখন শয়তান তাকে কৌশলে গ্রাস করে ফেলে। তখন তার নিজের কথা,
কাজ ও কৌশলকে নিখুঁত, নির্ভেজাল ও সর্বোত্তম ভাবতে শুরু করে।
অন্যের বিশ্বাস, কথা ও কাজকে সন্দেহ করতে থাকে এবং
অন্যের ভুলকে বড় করে ধরে নিজের গৌরবকে ফুটিয়ে তোলে।
২. নিজের বোকামি থাকলে অন্যকেও বোকা মনে করে;
যা প্রকান্তরে অহংকার।
৩. নিজের বড় বড় ত্রুটি ঢাকতে অন্যের ত্রুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
৪. আল্লাহর ভয় কম থাকলে বা না থাকলে অহংকার ঢুকে যায়।
৫. নিজের আশ-পাশে চাটুকার ও অযোগ্য লোক থাকলেও লোকেরা অহংকারী হয়ে যায়।
৬. নিজে যা পাবার যোগ্য তার চেয়ে বেশি পেয়ে গেলেও মানুষে অহংকারী হয়ে যায়।
৭. নিজের প্রশংসা অন্যের মুখে বেশী করে শুনতে থাকলেও মানুষ অহংকারী হয়ে যায়।
৮. নিজের আত্মসমালোচনা যত কম হয়,
অহংকার ততবেশি পেয়ে যায়।
৯. অন্যের মুখে নিজের সমালোচনা শোনার ধৈর্য্য কমে গেলেও আস্তে আস্তে মনে অহংকার ঢুকে পড়ে।
১০. কথা-কাজ-আচরণে বিনয় কমে গেলে অহংকার জায়গা করে নিতে থাকে।
অহংকারের কারণসমূহ
১. অন্যের সম্মান দেখে অহংকারী হওয়া :
আদমের উচ্চ সম্মান দেখে ইবলীস অহংকারী হয়ে ওঠে এবং সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ
قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلاَّ إِبْلِيسَ أَبَى
وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ -
‘অতঃপর যখন আমরা ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর। তখন তারা সবাই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার দেখালো। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল (বাক্বারাহ
২/৩৪)।
যুগে যুগে এটা জারি আছে। যেজন্য নবী-রাসূলগণ ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ সর্বদা অহংকারী সমাজনেতাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও অহংকারীরা সর্বদা নিজেদের সাফাই গেয়ে মিথ্যা বলে থাকে।
২. মালের আধিক্য :
অধিক ধন-সম্পদ মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে তোলে। মাল ও সন্তান মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। কিন্তু মানুষ অনেক সময় এর দ্বারা ফেৎনায় পতিত হয় এবং অহংকারে স্ফীত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ ক্বারূণের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
إِنَّ
قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ
الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ
قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْفَرِحِينَ- ...
قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللهَ
قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً
وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلاَ يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ-
‘ক্বারূণ ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। আমরা তাকে এমন ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম, যার চাবিসমূহ বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিকদের পসন্দ করেন না।’ ... ‘সে বলল,
এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে,
আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চাইতে শক্তিতে প্রবল ছিল এবং সম্পদে প্রাচুর্যময় ছিল। আর অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না (তারা সরাসরি জাহান্নামে যাবে)’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৬,
৭৮)।
ক্বারূণী ধন সবাই পেতে চায়। কিন্তু তা মানুষকে অহংকারী করে তোলে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে।
যেমন আল্লাহ বলেন,
فَخَسَفْنَا
بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ
دُونِ اللهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ-
‘অতঃপর আমরা ক্বারূণকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে ধ্বসিয়ে দিলাম। ফলে তার পক্ষে এমন কোন দল ছিল না,
যে আল্লাহর শাস্তি হতে তাকে সাহায্য করতে পারে এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮১)।
৫. বংশ মর্যাদা :
বংশ মর্যাদা মানুষের উচ্চ সম্মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদন্ড। এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে, যতক্ষণ বংশের লোকেরা বিনয়ী ও চরিত্রবান থাকে। উক্ত দু’টি গুণ যত বৃদ্ধি পায়,
বংশের সম্মান ও মর্যাদা তত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি সেখানে কথায় ও আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়,
তাহলে কচুর পাতার পানির মত উক্ত সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إِنَّ
اللهَ أَوْحَى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ
وَلاَ يَبْغِى أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ
‘আল্লাহ আমাকে প্রত্যাদেশ করেছেন যে,
তোমরা বিনয়ী হও। তোমাদের কেউ যেন একে অপরের উপর গর্ব না করে এবং একে অপরের উপর ঔদ্ধত্য প্রদর্শন না করে’।
মুসলিম হা/২৮৬৫; মিশকাত হা/৪৮৯৮ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘পরস্পরে গর্ব’ অনুচ্ছেদ।
তিনি বলেন, লোকেরা যেন তাদের (মুশরিক) বাপ-দাদার নামে গর্ব করা হ’তে বিরত থাকে, যারা মরে জাহান্নামের অঙ্গারে পরিণত হয়েছে ... নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদার অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। এক্ষণে সে আল্লাহভীরু মুমিন (مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ) অথবা হতভাগ্য পাপী (فَاجِرٌ شَقِيٌّ) মাত্র। মানবজাতি সবাই আদমের সন্তান। আর আদম হ’ল মাটির তৈরী’ (অতএব অহংকার করার মত কিছুই নেই
)। তিরমিযী হা/৩২৭০; আবুদাঊদ হা/৫১১৬; মিশকাত হা/৪৮৯৯।
তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন
,لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا
أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُه
‘তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না,
যেরূপ খ্রিষ্টানরা মারিয়ামপুত্র ঈসার ব্যাপারে করেছে। আমি আল্লাহর একজন বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা বলো,
আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’। বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।
সঙ্গত কারণে বিশেষ অবস্থায় বংশ মর্যাদাকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে।
যেমন :
ক) বৈবাহিক সমতার ক্ষেত্রে। বুখারী হা/৫০৯০, মুসলিম হা/১৪৬৬, মিশকাত হা/৩০৮২ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।
খ) রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে।
যেমন পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলে যান,
الأَئِمَّةُ
مِنْ قُرَيْشٍ
‘নেতা হবেন কুরায়েশদের মধ্য থেকে’।
আহমাদ হা/১২৩২৯, ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৫৮, বুখারী হা/৭১৩৯,
ফাৎহুল বারী,
উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ,
ইরওয়াউল গালীল হা/৫২০।
তাঁর মৃত্যুর পরে খলীফা নির্বাচন নিয়ে মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হ’লে উক্ত হাদীছটির মাধ্যমে সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। অতঃপর সবাই মুহাজির নেতা আবুবকর (রাঃ)-কে খলীফা হিসাবে মেনে নেন।
এই সিলসিলা খেলাফতে রাশেদাহ, খিলাফতে বনু উমাইয়া ও আববাসীয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
গ) যুদ্ধকালীন সময়ে। যেমন হোনায়েন যুদ্ধে শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় সৃষ্ট মহা সংকটকালে দৃঢ়চেতা রাসূল (ছাঃ) খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
أَنَا
النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ، أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ
‘আমিই নবী মিথ্যা নই। আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র।’ রাবী বলেন, সেদিন তাঁর চাইতে দৃঢ় কাউকে দেখা যায়নি’।
বুখারী হা/৩০৪২, মুসলিম হা/১৭৭৬, মিশকাত হা/৪৮৯৫।
এখানে তিনি আরবের শ্রেষ্ঠ বংশের নেতার পুত্র হিসাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন। এর দ্বারা তিনি শত্রুদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে,
কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান আমি বুক দিতে জানি, পিঠ দিতে জানি না। বস্ত্ততঃ তাঁর এই হুমকিতে দারুণ কাজ হয়। মাত্র ২০ দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী কুরায়েশ নেতা আববাস, আবু সুফিয়ান বিন হারেছ, হাকীম বিন হিযাম সহ অন্যেরা সবাই দ্রুত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে এসে দাঁড়ান এবং মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। শত্রুপক্ষ নিমেষে পরাজিত হয় ও পালিয়ে যায়।
বংশ মর্যাদার এই তারতম্যকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করলেই সেটা দোষের হয়। অন্যায়ভাবে বংশের গৌরব করাকে তিনি ‘জাহেলিয়াতের অংশ’ (عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ) বলে ধিক্কার দিয়েছেন।
তিরমিযী হা/৩৯৫৫, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৮৯৯।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
فَخِيَارُكُمْ
فِى الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِى الإِسْلاَمِ إِذَا فَقِهُوا
তোমাদের মধ্যে যারা জাহেলী যুগে উত্তম ছিলে, তারা ইসলামী যুগেও উত্তম, যদি তারা দ্বীনের জ্ঞানে পারদর্শী হয়’।
বুখারী হা/৪৬৮৯, মুসলিম হা/২৩৭৮, মিশকাত হা/৪৮৯৩।
হযরত ইউসুফ )আ.) - এর প্রশংসায় তিনি বলেন,
الْكَرِيمُ
ابْنُ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ يُوسُفُ بْنُ يَعْقُوبَ بْنِ
إِسْحَاقَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ
সম্ভ্রান্তের পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত ও তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁরা হ’লেন ইবরাহীম, তাঁর পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব এবং তাঁর পুত্র ইউসুফ’।
বুখারী হা/৩৩৯০; তিরমিযী হা/৩৩৩২; মিশকাত হা/৪৮৯৪।
এতে বুঝা যায় যে,
বংশমর্যাদা প্রশংসিত। কিন্তু অন্যায়ভাবে তার ব্যবহারটা নিন্দনীয়।
ইসলামে দ্বীন ও আল্লাহভীতিকে সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
إِنَّ
أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ
‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু’
হুজুরাত ৪৯/১৩
যেমন দ্বীন ও তাক্বওয়ার কারণেই কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তদাস বেলাল উচ্চ সম্মান লাভ করেছিলেন। ওমর (রাঃ) বলতেন,
أَبُو
بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا، يَعْنِى بِلاَلاً
‘আবুবকর আমাদের নেতা এবং তিনি মুক্ত করেছেন আমাদের নেতাকে (অর্থাৎ বেলালকে)’।
বুখারী হা/৩৭৫৪।
মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে কা‘বাগৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিতে বলেন। তার এই উচ্চ সম্মান দেখে কুরায়েশ নেতারা সমালোচনা করেছিলেন।
সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪১৩।
ওযূ নষ্ট হলেই তাহিইয়াতুল ওযূ এবং আযানের পরেই মসজিদে তাহিইয়াতুল মাসজিদ-এর নফল ছালাত আদায়ের নিয়মিত সদভ্যাসের কারণেই জান্নাতে বেলালের অগ্রগামী পদশব্দ স্বপ্নের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) শুনেছিলেন ও তার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩২২; তিরমিযী, আহমাদ, মিশকাত হা/১৩২৬ ‘ঐচ্ছিক ছালাত’ অনুচ্ছেদ।
বস্ত্ততঃ ইসলামের উদার সাম্যের কারণেই কুরায়েশ নেতা আবুবকর ও ওমরের পাশাপাশি পায়ে পা লাগিয়ে ছালাতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন আবিসিনিয়ার বেলাল হাবশী, রোমের ছুহায়েব রূমী, পারস্যের সালমান ফারেসী প্রমুখ ক্রীতদাসগণ। কোটি কোটি মুসলমান তাদের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে দো‘আ করে বলেন, ‘রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু’ (আল্লাহ তার উপরে সন্তুষ্ট হউন!)। স্রেফ দ্বীনের কারণে বেলাল এখানে উচ্চ সম্মানিত। পক্ষান্তরে কুফরীর কারণে তার মনিব উমাইয়া বিন খালাফ হলেন অপমানিত ও লাঞ্ছিত। অথচ তিনি ছিলেন অন্যতম কুরায়েশ নেতা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আপন চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী। অতএব ইসলামে বংশ মর্যাদা স্বীকৃত ও প্রশংসিত হলেও দ্বীন ও তাক্বওয়া না থাকলে তা নিন্দিত ও মূল্যহীন। এখানে সকলের সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হ’ল ঈমান ও তাক্বওয়া। মুসলমান সবাই ভাই ভাই। দাস-মনিবে কোন প্রভেদ নেই। পৃথিবীর কোন সমাজ ব্যবস্থায় এর কোন নযীর নেই। কেবল অহংকারী ব্যক্তিরাই এর বিপরীত আচরণ করে থাকে।
৬. সুন্দর চেহারা:
মানুষের অহংকার করার অন্যতম একটি কারণ হলো
সুন্দর চেহারা। মানুষের আকৃতি, কালার এবং চেহারার গঠন সবকিছু আল্লাহর আদেশে
অনুযায়ী হয়। এখানে ব্যক্তির কোনো হাত নেই। এই চেহারার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বনী আদমকে
পরীক্ষা করেন। যে বান্দা আমার দেয়া চেহারা পেয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়। আমার শুকরিয়া
আদায় করে না কি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। সুতরাং চেহারা বা মানুষের শারীরিক গঠন তার জন্য
পরীক্ষাস্বরুপ! তাই এক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক
ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
অহংকারী মানুষ চেনার সহজ পাঁচটি উপায় সম্পর্কে –
১. বড়াই করা:
অত্যধিক বড়াই করা একজন অহংকারী ব্যক্তির সবচেয়ে সুস্পষ্ট লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি।
কোনো বস্তুগত সম্পদ হোক কিংবা মর্যাদা বা নির্দিষ্ট কোনো কিছুই অর্জনই হোক না কেন,
তারা সবসময় আপনাকে আগ বাড়িয়ে জানাতে চান,
আর,
তারা তাদের জীবনে কতটা সফলতা পাচ্ছেন বা কত বিশাল কিছু অর্জন করছেন, সেই বিষয়েও বড়াই করতে ছাড়েন না।
আপনি লক্ষ্য করতে পারেন, যে আপনি যদি কোনো ধরণের সফলতার উদযাপন করেন, তবে একজন অহংকারী ব্যক্তি আপনাকে অভিনন্দন জানানোর পরিবর্তে আপনার সাথে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবহার করেন।
সেই সব ব্যক্তিরা সবসময়েই তাদের নিজেদের কৃতিত্ব বা জীবনের জয় নিয়ে আনন্দ করার জন্য তাদের নিজেদের দিকে ফোকাস নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
২. অশালীন ব্যবহার করা:
অহংকারবোধ মানুষের মনে প্রায়শই অন্যের উপরে চাপ প্রয়োগের মনোভাব তৈরী করে দেয়।
যার কারণে, একজন অহংকারী মানুষ সামাজিক ব্যবস্থায় অবিশ্বাস্যভাবে অশালীন আচরণ করতে পারেন।
তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যে তারা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তাই, তাদের অন্য মানুষের অনুভূতি বা চাহিদা সম্পর্কে বিবেচনা করার বুদ্ধির অভাব থাকে।
আর, যেভাবেই হোক তারা সবসময় নিজেদের প্রথম স্থানে রাখতে ভালোবাসেন।
এই ধরণের একরোখা ও স্বার্থপর ব্যবহারের কারণে অনেকের কাছেই তারা অসভ্য মানসিকতার মানুষ হয়ে ওঠেন।
আপনি খেয়াল করে দেখবেন, যে অহংকারী লোকেদের মধ্যে মানুষকে নিকৃষ্ট ও নগন্য প্রমাণ করার প্রবণতা থাকে।
তাই, তারা সর্বদা তাদের যোগ্যতার নিচে থাকা ব্যক্তিদের সাথে অশালীন ও অপমানজনক ব্যবহার করে থাকেন।
৩. তারা নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত মনোভাব পোষণ করেন:
একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, ‘যে বুদ্ধিমানরা সন্দেহে ভরপুর থাকে আর মূর্খরা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকে’।
অর্থাৎ, একজন অহংকারী ব্যক্তি তার সামর্থ্যকে অতিরিক্ত মাত্রায় মূল্যায়ন করে থাকেন।
প্রাথমিকভাবে, একজন অহংকারী ব্যক্তি তার মসৃণ কথা বলার ধরণের সাহায্যে অনেক ভাল চাকরি বা ক্ষমতার পদে আসীন হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
যদিও, তাদের নিজস্ব ক্ষমতার উপর জন্মানো এই ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত যখন ভেঙে যায়,
তখন তারা তাদের আসল যোগ্যতার প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন।
৪. তারা মনে করেন, যে তারা সবসময়েই সঠিক:
আপনার বিপদে একজন অহংকারী ব্যক্তির সাথে সবসময়েই একমত হবেন, কারণ তারা নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে যেকোনো কাজ করতে পারেন।
কারণ, তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে, অতি তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর বিষয়েও নিজের ধারণাকে সঠিক বলে প্রমাণিত করা।
আর, কখনোই কোনো যুক্তিকে হাতছাড়া না করা আর তাদের মতামত ও বিশ্বাসকে প্রচণ্ডভাবে রক্ষা করাই হল তাদের চরম অহংকারবোধের প্রধান লক্ষণ।
তারা প্রায়শই স্বাধীন মানসিকতার পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট ভাবধারা নিয়ে চলেন, যা তাদের অন্যান্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিবেচনা করা থেকে বিরত রাখে।
৫. তারা রক্ষণাত্মক ব্যবহার করেন:
একজন অহংকারী ব্যক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ বা সমালোচনা হল তাদের অহংবোধের জন্যে খুবই মারাত্মক একটা ব্যাপার। তাই, কোনো রকম কোনো জটিল সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে, যেকোনো অহংকারী মানুষ অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিরক্ষামূলক হয়ে ওঠেন।
এর কারণ হল,
প্রকৃতপক্ষে তারা মানসিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বা তারা কোনো অনুভূত হুমকি থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকেন।
কখনও কখনও সেই রক্ষণাত্মক মনোভাব মতামতের পার্থক্য বা কিছু বিষয়ে ভুল প্রমাণিত হওয়ার মতো সামান্য ঘটনা থেকেও শুরু হতে পারে।
অহংকারের পরিণতি:
وَعَن سَلَمَةَ بنِ الْأَكْوَعِ أنّ رَجُلًا أكَلَ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ بِشِمَالِهِ فَقَالَ كُلْ بيَمِينِكَ قَالَ : لاَ أسْتَطِيعُ قَالَ لَا اسْتَطَعْتَ مَا مَنَعَهُ إِلاَّ الكِبْرُ قَالَ : فما رفَعها إِلَى فِيهِ رواه مسلم
সালামাহ ইবনে আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তার বাম হাত দ্বারা খেল। তিনি বললেন, ’’তোমার ডান হাত দ্বারা খাও।’’ সে বলল, ’আমি অপারগ।’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), তুমি (যেন ডান হাতে খেতে) না পারো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা মানতে তাকে অহংকারই বাধা দিয়েছিল। বর্ণনাকারী বলেন, ’(তারপর) থেকে সে তার ডান হাত মুখ পর্যন্ত উঠাতে পারেনি। (মুসলিম ৫৩৮৭)
কিয়ামতের দিনের শাস্তি:
وعَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِي صُوَرِ النَّاسِ يَعْلُوهُمْ كُلُّ شَيْءٍ مِنْ الصَّغَارِ حَتّٰـى يَدْخُلُوا سِجْنًا فِي جَهَنَّمَ يُقَالُ لَهُ بُولَسُ فَتَعْلُوَهُمْ نَارُ الْأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ طِينَةِ الْخَبَالِ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ
আমর বিন শুআইব, তিনি তাঁর পিতা হতে,
তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অহংকারীদেরকে কিয়ামতের দিন মানুষের আকৃতিতেই পিঁপড়ের মত ছোট আকারে জমা করা হবে। তাদেরকে সর্বদিক থেকে লাঞ্ছনা ঘিরে ধরবে। তাদেরকে ’বূলাস’ নামক দোযখের এক কারাগারে রাখা হবে। আগুন তাদেরকে ঘিরে ফেলবে এবং তাদেরকে জাহান্নামীদের রক্ত-পুঁজ পান করানো হবে।
(আহমাদ ৬৬৭৭, তিরমিযী ২৪৯২, আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।)
عَنْ اَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ
اللهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَة وَلاَ يُزَكِّيْهِمْ وَلَا يَنْظُرُ إلَيْهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ ألِيْمٌ : شَيْخٌ زَانٍ وَمَلِكٌ كَذَّابٌ وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ رواه مسلم
আবু হুরায়রাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন প্রকার লোকের সাথে কথা বলবেন না,
তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের দিকে (অনুগ্রহের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, ১.
ব্যভিচারী বৃদ্ধ ২. মিথ্যাবাদী বাদশাহ ৩. অহংকারী গরীব। ( মুসলিম ৩০৯)
উপসংহার:
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, অহংকার স্রষ্টার চাদর! তাঁর জন্যই অহংকার শোভনীয়। কোনো সৃষ্টির জন্য এটা
গ্রহণযোগ্য নয়। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝের প্রাচীর হলো অহংকার! তাই কোনো সৃষ্টিজীব যখন
এই সীমা অতিক্রম করে তখন সে বনী আদমের মর্যাদা মূলত ধ্বংস করে দেয় এবং সে ইবলিশের দলভূক্ত
হয়ে যায়। তার জন্য ধ্বংস অনিবার্য হয়ে যায়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে অহংকারের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর প্রিয় বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন
সংকলক,
(বি.টি.আই.এস – অনার্স, এম.এ – মাস্টার্স)
আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
No comments
Post a Comment