”কুরবানী : ইতিহাস, উদ্দেশ্য, শিক্ষা, পশু ও গোশ্ত বণ্টন”
”কুরবানী : ইতিহাস, উদ্দেশ্য, শিক্ষা, পশু ও
গোশ্ত বণ্টন”
এইচ.এম.হুজ্জাতুল্লাহ
কুরবানীর আভিধানিক অর্থ :
আরবী قرب বা قربان শব্দটি উর্দূ ও ফার্সীতে قربانى (কুরবানী) রূপে রূপান্তরিত হয়েছে। যার অর্থ, নৈকট্য, সান্নিধ্য। পবিত্র কুরআন ও হাদীছে এর কয়েকটি সমার্থক শব্দ পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
(১) نحر অর্থে। যেমন- আল্লাহ রাববুল আলামীনের বাণী فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন’ (কাওছার ২)। এই অর্থে কুরবানীর দিনকে يوم النحر বলা হয়।
(২) نسك অর্থে। যেমন- মহান আল্লাহর বাণী- قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ
وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ- ‘আপনি বলুন, আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত’ ।
(আন‘আম ১৬২)।
(৩) منسك অর্থে। যেমন আল্লাহর বাণী- لِكُلِّ أُمَّةٍ
جَعَلْنَا مَنْسَكاً ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানীর বিধান রেখেছি।
(হজ্জ ৩৪)।
(৪) الاضحى অর্থে। হাদীছে এসেছে- এই অর্থে কুরবানীর ঈদকে عيد الاضحى বলা হয়।
কুরবানীর উৎপত্তি: আদম (আ.)-
কোরবানির ইতিহাস খুবই প্রাচীন। আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। পৃথিবীর প্রথম কোরবানি আদম (আ.) এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কোরআন থেকে জানতে পারি। কুরআন মাজিদে কুরবানীর ইতিহাসের তিনটি স্তরের
বর্ণনা এসেছে-
প্রথম
স্তর: আদম (আ.) থেকে।
আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন-
وَاتْلُ
عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَاناً فَتُقُبِّلَ
مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنْ الآخَرِ قَالَ لأَقْتُلَنَّكَ قَالَ
إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنْ الْمُتَّقِينَ
‘আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হল এবং অন্য জনের কোরবানি কবুল হল না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কোরবানিই কবুল করে থাকেন।’
(সুরা মায়েদা: আয়াত ২৭)
দ্বিতীয় স্তর: আদম (আ.) এর পরবর্তীতে উম্মাহর মধ্যে।
আদম (আ.) এর সময় থেকে
কুরবানী প্রথা শুরু হয়ে পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে তা বিদ্যমান ছিল।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرْ الْمُخْبِتِينَ - الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَالصَّابِرِينَ عَلَى مَا أَصَابَهُمْ وَالْمُقِيمِ الصَّلاةِ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ
‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছি; যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ সবরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। সুতরাং তোমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ কর। আর সুসংবাদ দাও বিনীতগণকে; যাদের হৃদয় ভয়ে কম্পিত হয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে; যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে, নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রুজি দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে ।
( সুরা হজ: আয়াত ৩৪-৩৫)
তৃতীয় স্তর: ইবরাহীম (আ.) থেকে চলমান।
পৃথিবীতে
নবি-রাসূলগণ ছিলেন আল্লাহ তায়ালা মনোনীত ও সর্বশ্রেষ্ঠ
মানুষ।
এজন্য নবি-রাসূলগণকে তিনি সবচেয়ে বেশি ও কঠিন
পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন।
তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইবরাহীম (আ.)। প্রিয়পুত্রকে
আল্লাহর জন্য কুরবানী করা।
সন্তানদের
প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা আর ত্যাগ
সত্যিই অবাক করার মত।
নিজেরা শত কষ্ট স্বীকার করে নেন প্রিয় সন্তানের মুখে হাসি দেখার জন্য। অথচ
সেই সন্তানকে আল্লাহর হুকুমে কুরবানী করতে হবে!!! একবার ভেবে দেখেছেন বিষয়টা কতটা কঠিন?
আমরা জানি যে, ইবরাহীম (আ.)
বৈবাহিক জীবনের সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয় নিঃসন্তান অবস্থায়।
জীবনের শেষ পর্যায় যেয়ে তাঁর সংসারে প্রথম সন্তান আসে, তিনি হলেন ইসমাঈল (আ.)।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে সে সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللهُ مِنَ الصَّابِرِينَ- فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ- وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ- إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاء الْمُبِينُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ - وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ
অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত’; সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন’। অতঃপর পিতা-পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, ‘হে ইবরাহীম, ‘তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। নিশ্চয় আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি’। ‘নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক বড় যবেহ এর বিনিময়ে। আর আমি তাকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম।
(সুরা সাফফাত: আয়াত ১০২-১০৮)
কুরবানীর
উদ্দেশ্য:
মহান
আল্লাহর নৈকট লাভের এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কুরবানীর বিধান শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
এসম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
لَنۡ
یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنۡ یَّنَالُهُ التَّقۡوٰی
مِنۡكُمۡ ؕ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُوا اللّٰهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمۡ
ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُحۡسِنِیۡنَ
আল্লাহর কাছে পৌছায় না সেগুলোর গোশত এবং রক্ত, বরং তার কাছে পৌছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই তিনি এদেরকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে হেদায়াত করেছেন; কাজেই আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।
(সুরা হাজ্জ, আয়াত নং ৩৭)
তাকওয়া
– এর পরিচয়:
তাকওয়া (আরবি: تقوى) শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, নিষ্কৃতি লাভ করা,
ভয় করা,
নিজেকে রক্ষা করা। ব্যবহারিক অর্থে: দ্বীনদারি, ধার্মিকতা, পরহেজগারি, আল্লাহভীতি, আত্মশুদ্ধি , আল্লাহ ও সত্যের প্রতি সচেতন এবং পরিজ্ঞাত হওয়া, "ধর্মপরায়ণতা, আল্লাহর ভয়" ইত্যাদি বোঝায়।
তাক্বওয়ার পারিভাষিক অর্থ:
ان عمر بن الخطاب (رض) سأل أبي بن
كعب (رض) عن التقوي فقال أما سلكت طريقا ذا شوق قال بلي فما عملت قال شمرتُ
واجتهدتُ قال فذالك التقوي
“উমর ইবন খাত্তাব (রা.) একবার উবাই ইবন কা’ব (রা.)-কে তাক্বওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে উবাই ইবন কা’ব (রা.) বলেন, আপনি কি কাঁটাযুক্ত (কন্টকাকীর্ণ) পথে চলেছেন? উমর (রাঃ) বলেন, হ্যাঁ। উবাই ইবন কা’ব (রা.) পুনরায় বললেন, কিভাবে চলেছেন? জবাবে উমর (রা.) বলেন,
“পোশাকে যেন কাঁটা বিদ্ধ না হয়, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে সে জন্য চেষ্টা করেছি ও সতর্কভাবে চলেছি। উবাই (রা.) বলেন, এটাই হচ্ছে তাক্বওয়া এর উদাহরণ।
তাক্বওয়ার মৌলিক বিষয়
তাক্বওয়ার মৌলিক বিষয় হচ্ছে তিনটি।
যথাঃ-
ক। শিরক হতে বিরত থাকার মাধ্যমে নির্দিষ্ট শাস্তি হতে আত্নরক্ষা করা।
খ। গুনাহ থেকে দূরে থাকা।
গ। এমন কাজ থেকে দূরে থাকা, যা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে দেয়।
তাক্বওয়ার স্তর সমূহঃ
ইমাম গায্যালী (রঃ) গুণগত ও মানগত দিক দিয়ে তাক্বওয়াকে চারটি স্তরে বিভক্ত করেছেন। যথাঃ-
ক। শরীআত কর্তৃক নির্ধারিত হারাম থেকে বিরত থাকা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে“مؤمن মু’মিন’ বলে।
খ। সন্দেহযুক্ত হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে ‘ صلحاء সুলাহা’ বলা হয়।
গ। আল্লাহর ভয়ে অপ্রয়োজনীয় হালাল বস্তু বর্জন করা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে ‘ اتقياء আতক্বিয়া’ বলা হয়।
ঘ। যে সকল হালাল বস্তু আল্লাহর ইবাদতে সহায়তা করে না তা বর্জন করা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে ‘ صديقين সিদ্দীক্বীন’ বলা হয়।
আল্লামা রাগিব ইস্পাহানী পরহিযগারিতাকে তিনটি স্তরে বিন্যাস করেছেন। যথাঃ-
১। ওয়াজিবঃ সকল প্রকার হারাম থেকে বেঁচে থাকা। এ প্রকারের পরহিযগারিতা অর্জন করা সকল মানুষের উপর ওয়াজিব।
২। মুস্তাহাবঃ সন্দেহপূর্ণ বস্তুসমূহ থেকে বেঁচে থাকা। মধ্যম স্তরের পরহিযগার ব্যক্তিদের জন্য এ স্তরটি প্রযোজ্য।
৩। মাফযূলঃ অনেক মুবাহ এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় বস্তু সমূহ থেকেও বিরত থাকা। নবী-রাসূল, শহীদ এবং সালিহ বান্দাদের জন্য এ স্তরটি প্রযোজ্য।’’
(-রাগিব ইস্পাহানী, আয-যারী’আহ ইলা মাকারিমিশ শারী’আহ, (কায়রো : দারুস সালাম, ২০০৭),
পৃ. ২২৭)
তাক্বওয়ার সর্বোচ্চ স্তর:
আল্লাহ ভীতির সর্বোচ্চ স্তর হল না-জায়েয কাজে জড়িয়ে পরার ভয়ে কোন কোন জায়েয কাজও পরিত্যাগ করা। কেননা, যা কিছু স্পষ্ট পাপ,
তা তো সকলেই বর্জন করবে এবং যা কিছু স্পষ্ট সওয়াব তাও তো সকলেই আমল করবে কিন্ত যা কিছু সন্দেহপূর্ণ সেখানেই তো প্রকৃত ঈমানের পরীক্ষা।
তাই তো রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: الحَلاَلُ بَيِّنٌ وَالحَرَامُ بَيِّنٌ، وَبَيْنَ ذَلِكَ أُمُورٌ مُشْتَبِهَاتٌ، لاَ يَدْرِي كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ أَمِنَ الحَلاَلِ هِيَ أَمْ مِنَ الحَرَامِ، فَمَنْ تَرَكَهَا اسْتِبْرَاءً لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ فَقَدْ سَلِمَ، وَمَنْ وَاقَعَ شَيْئًا مِنْهَا، يُوشِكُ أَنْ يُوَاقِعَ الحَرَامَ (ترمذى
“হালাল সুস্পষ্ট, হারামও সুস্পষ্ট । আর এদুয়ের মাঝখানে রয়েছে কিছু সন্দেহজনক জিনিস। অধিকাংশ লোকেরা অবগত নয় যে এগুলো হালাল নাকি হারাম। কাজেই যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক জিনিস থেকে দূরে থাকল, সে তার দ্বীন ও ইজ্জতকে হিফাযত করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ল, সে হারামের মধ্যে ফেঁসে গেল।’’ –(তিরমিযীঃ ১২০৫)
কুরবানীর শিক্ষা:
ইবরাহীম (আ.) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেয়ার সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেভাবে ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে ত্যাগের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ ও প্রেরণায় আমরা আমাদের জীবনকে ঈমানী আলোয় উজ্জীবিত করব,
এটাই কুরবানীর মৌলিক শিক্ষা।
ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। মহান ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত প্রশান্তি। কুরবানী আমাদেরকে আরও শিক্ষা দেয় যে,
দুনিয়াবী সকল মিথ্যা, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, যুলুম, হানাহানি, স্বার্থপরতা, দাম্ভিকতা, অহমিকা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে পৃথিবীতে শান্তি ও সাম্যের পতাকা সমুন্নত রাখতে।
পশু কুরবানী মূলত নিজের নফস তথা কুপ্রবৃত্তিকে কুরবানী করার প্রতীক। কুরবানী আমাদেরকে সকল প্রকার লোভ-লালসা, পার্থিব স্বার্থপরতা ও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনার জৈবিক আবিলতা হ’তে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে মহান স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত বান্দা হওয়ার প্রেরণা যোগায় এবং সত্য ও হকের পক্ষে আত্মোৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। কুরবানীর স্বার্থকতা এখানেই।
কুরবানীর পশু:
কুরবাণীর পশুর ধরণ হচ্ছে: উঁট,
গরু,
ছাগল, দুম্বা বা মেষ।
এসম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার বাণী:
(وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكاً
لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ
فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ
الْمُخْبِتِينَ)الحج 34
আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি। তাদেরকে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিযক্ দেয়া হয়েছে সেগুলোর উপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। কারণ, তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য, কাজেই তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ কর আর সুসংবাদ দাও বিনীতদেরকে।
(সূরা আল-হাজ্জ – ৩৪)
আর গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু হলো: উঁট,
গরু,
ছাগল, দুম্বা বা মেষ। আর কুরবানীতে একটি ছাগল, মেষ বা দুম্বা একজনের পক্ষ হতে যথেষ্ট হবে।
পক্ষান্তরে একটি উঁট বা গরু সাতজনের পক্ষ হতে যথেষ্ট হবে। উত্তম হলো একটি পরিবার পক্ষ থেকে একটি প্রাণী কুরবানী
করা।
কুরবানীর পশুতে যে সব গুণ থাকা আবশ্যক:
আর তা হচ্ছে দু’টি:
১। পশুর শরীয়াত নির্ধারিত বয়স হওয়া। আর তা হচ্ছে, উঁটের বয়স পাঁচ বছর সম্পূর্ণ হওয়া, গরুর বয়স দুই বছর সম্পূর্ণ হওয়া, ছাগলের বয়স এক বছর সম্পূর্ণ হওয়া, মেষ বা দুম্বার বয়স ছয় মাস পূর্ণ হওয়া। এর কম বয়সের হলে তা কুরবানীতে যথেষ্ট হবে না।
দলীল নবী (সা.) এর হাদীস:
لَا
تَذْبَحُوا إِلَّا مُسِنَّةً إِلَّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوا
جَذَعَةً مِنْ الضَّأْنِ
তোমরা দাঁতা পশু ব্যতীত অন্য কোন পশু (কুরবানীতে) যবহ করবে না। তবে যদি তোমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে তাহলে দুম্বা বা মেষের জায্’আ (যার বয়স ছয় মাস) যবহ্ করবে।
(সহীহ মুসলিম ১৯৬৩)
২। চারটি দোষ হতে কুরবানীর পশুর মুক্ত হওয়া, যা থেকে নাবী (সা.) কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে বেঁচে থাকতে বলেছেন। আর তা হলো:
ক। স্পষ্ট কানা হওয়া। আর দুই চোখের অন্ধ হওয়া আরো বড় দোষ, তাই তা যথেষ্টে হবে না।
খ। স্পষ্ট রোগী হওয়া, যেমন চুলকানী-পাচড়া বা অন্য কোন ব্যধীতে আক্রান্ত হওয়া।
গ। স্পষ্ট খোঁড়া হওয়া এবং এমন অচল হওয়া যা চলতে পারে না। তাই কোন একটি পা কাটা হওয়া আরো বড় দোষ।
ঘ। আর এমন দুর্বল হওয়া যার শরীরে কোন মাংস নেই।
(সহীহ: ইবনে মাজাহ ৩১৪৪)
আর কুরবানীর পশুতে যে সব গুণ থাকা উত্তম:
কুরবানীর পশুর মোটা হওয়া, শক্তিশালী হওয়া, দৈহিক গঠনে বড় হওয়া এবং দেখতে সুন্দর হওয়া। সুতরাং কুরবানীর পশু যত ভাল হবে ততই মহান আল্লাহর নিকট তা প্রিয় হবে। আর সহীহ হাদীসে রয়েছে, আল্লাহ সুন্দর ও উত্তম, তাই তিনি সুন্দর ও উত্তম ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করেন না।
কুরবানীর মাংস বিতরণের নিয়ম-পদ্ধতি:
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
فَكُلُوۡا
مِنۡهَا وَ اَطۡعِمُوا الۡبَآئِسَ الۡفَقِیۡرَ
সুতরাং তোমরা (নিজেরা) তা থেকে খাও, আর দুঃস্থ-অভাবীদের খাওয়াও।
(সূরাহ আল-হাজ্জ – ২৮)
আর নাবী (সা.) তাঁর হাজ্জের অবস্থায় প্রত্যেকটি কুরবানীর পশু হতে এক-এক টুকরো মাংস নিয়ে পাত্রে একত্রিত করে রান্না করতে বলেন, অতঃপর তা হতে কিছু খান এবং তার ঝোল পান করেন।
(সহীহ মুসলিম)
তাই সুন্নাত হলো,
কুরবানীর মাংস নিজে খাওয়া এবং তা হতে অন্যদেরও খাওয়ানো।
আমাদের সমাজে কুরবানীর গোশ্ত তিন ভাগ করার নিয়ম প্রচলিত আছে। এক ভাগ কুরবানী দাতা নেন, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদেরকে দেয়া হয় এবং এক ভাগ সমাজে বিতরণের জন্য দান করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে, যে অংশ কুরবানীদাতা দান করেন তা থেকে তিনি আবার নেন!
কথা হলো যে অংশ আপনি অভাবীদের জন্য দান করলেন সে অংশ থেকে কেনো আপনি নিচ্ছেন???
দান করে তা আবার গ্রহণ করা কত বড় অপরাধ তা কি জানেন?
চলুন
জেনে নেয়া যাক- হাদীসে এসেছে-
রাসুল
(সা.) বলেন,
عَنْ
عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ، قَالَ: مَثَلُ الَّذِي يَسْتَرِدُّ مَا وَهَبَ كَمَثَلِ الْكَلْبِ
يَقِيءُ فَيَأْكُلُ قَيْئَهُ، فَإِذَا اسْتَرَدَّ الْوَاهِبُ فَلْيُوَقَّفْ
فَلْيُعَرَّفْ بِمَا اسْتَرَدَّ ثُمَّ لِيُدْفَعْ إِلَيْهِ مَا وَهَبَ
حسن صحيح
আব্দুল্লাহ ইবনু ’আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ যে ব্যক্তির নিজের দান করা বস্তু ফেরত নেয় সে এমন কুকুরের মতো, যে বমি করে পুনরায় তা ভক্ষণ করে। দাতা দানকৃত বস্তু ফেরত চাইলে গ্রহীতা খতিয়ে দেখবে এবং জেনে নিবে, সে কি জন্য তার দানকৃত বস্তু ফেরত চাইছে। কারণ জানা গেলে তা ফেরত দিবে।
(হাসান সহীহঃ ইবনু মাজাহ (২৩৭৮) অনুরূপ সংক্ষেপে, দেখুন মিশকাতুল মাসাবীহ (৩০২০)
তিনি (সা.) আরো বলেন, তুমি ক্রয় করবে না এবং তোমার দান ফিরিয়ে নেবে না, সে তা এক দিরহামের বিনিময়ে দিলেও। কেননা যে ব্যক্তি নিজের দান ফিরিয়ে নেয় সে যেন নিজের বমি পুনরায় ভক্ষণ করে।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪৯০)
কুরবানীর
একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করা।
আমার কুরবানীর উদ্দেশ্য হয় যদি গোশ্ত খাওয়া বা মানুষকে দেখানো বা জানানো তাহলে সোয়াবের পরিবর্তে গোনাহ হবে। কারণ
লোক দেখানো কোনো ইবাদত আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না।
আসুন,
আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য কুরবানী করব এবং এর দ্বারা যেন আল্লাহ সন্তুষ্ট ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকে।
আল্লাহ আমাদের সকল ইবাদত শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্ট অর্জনের জন্য করার তাওফিক দান করুন।
আমিন
সংকলক,
(বি.টি.আই.এস – অনার্স, এম.এ
– মাস্টার্স)
আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
No comments
Post a Comment