কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী ইফতারের সঠিক সময়

    



            ইফতার করা নিয়ে বিতর্কের সমাধান =


রমাযান মাস রহমত, বরকত মাগফিরাতের মাস ৷ একজন মুসলিমের জীবনে মাসের গুরুত্ব অপরিসীম তাই আমরা ফযিলত পূর্ণ মাসে আল্লাহর আদেশ সিয়াম পালন করি কোন রকম মতানৈক্য ছাড়াই

      কিন্তু ইফতার আগে বা পরে করা নিয়ে আমাদের সমাজে প্রতি রমাদানেই বিতর্ক সৃষ্টি হয় কিছু মানুষ সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করেন আর কিছু মানুষ একটু বিলম্বে ইফতার করেন সমস্যাটা জড়ালো হয় যখন উভয় মতের মানুষ কোন এক ইফতারী অনুষ্ঠানে একত্রিত হন অনেক সময় এক পক্ষ অপর পক্ষকে কটুক্তিও করে থাকেন যা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম তাই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা খুবই জরুরী  মনে করছি

প্রতি রমাযানে এবিষয়ে আলোচনা চলছে সবাই নিজের মত করে জনসাধারণকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু সমাজে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হচ্ছে না

তাহলে সমাধানের উপায় কি ?

আমাদের মাঝে কোন বিষয়ে সমস্যার সৃষ্টি হলে তা সমাধানের জন্য আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে কুরআন সুন্নাহর দিকে

আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ 

ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا

তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।

             (সূরাঃ আন নিসা, আয়াতঃ ৫৯)

অত্র আয়াত দ্বারা বুঝতে পারলাম যে, কোন বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে নিজেরা বিবাদে লিপ্ত  না হয়ে  বরং কুরআন সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে আর এটাই মুমিনদের কাজ

ইফতার কখন করবো ?

ইফতার সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহ কি বলে সেটা দেখতে হবে

আল কুরআন থেকে =

    আল্লাহ তায়ালা বলেন

         ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّیَامَ اِلَی الَّیۡلِ

অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত।

            (সূরাঃ আল বাকারা, আয়াতঃ ১৮৭)

 এর দ্বারা সাব্যস্ত হচ্ছে যে, সূর্য অস্তমিত হওয়া মাত্রই ইফতার করা উচিত

      { তাফসীর ইবনে কাসীর, বাংলা (1,2,3) খন্ড 480 পৃঃ}

সুন্নাহ থেকে  

এবার দেখি রাসূল সাঃ এর সুন্নাহ কি বলে --


ü  নবী-রাসূলগণের সুন্নাহ !

إنا معشر الانبياء امرنا بتعجيل فطرنا وتأخير سحورنا                       

অর্থ, আমরা নবীগণ আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রথম সময়েই ইফতার করতে শেষ সময়ে সাহরী খেতে

( হাইসামী,মাজমউয যাওয়াইদ 2/105 ,3/155, হাদিসটির সনদ সহীহ )

অত্র হাদিস প্রমাণ করে, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতে নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেছেন


ü  নবী মুহাম্মাদ সা এর সুন্নাহ !

وَعَنْ أَبِي عَطِيَّةَ قَالَ: دَخَلْتُ أَنَا وَمَسْرُوقٌ عَلَى عَائِشَةَ فَقُلْنَا: يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ رَجُلَانِ مِنْ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحَدُهُمَا يُعَجِّلُ الْإِفْطَارَ وَيُعَجِّلُ الصَّلَاةَ وَالْآخَرُ: يُؤَخِّرُ الْإِفْطَارَ وَيُؤَخِّرُ الصَّلَاةَ. قَالَتْ: أَيُّهُمَا يُعَجِّلُ الْإِفْطَارَ وَيُعَجِّلُ الصَّلَاةَ؟ قُلْنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْعُودٍ. قَالَتْ: هَكَذَا صَنَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْآخَرُ أَبُو مُوسَى. رَوَاهُ مُسْلِمٌ

আবূ ‘আত্বিয়্যাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ও মাসরূক উভয়ে (একদিন) ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর কাছে গেলাম ও আমরা আরয করলাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’জন সাথী আছেন। তাদের একজন দ্রুত ইফতার করেন, দ্রুত সালাত আদায় করেন। আর দ্বিতীয়জন বিলম্বে ইফতার করেন ও বিলম্বে সালাত আদায় করেন। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তাড়াতাড়ি করে ইফতার করেন ও সালাত আদায় করেন কে? আমরা বললাম, ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপই করতেন। আর অপর ব্যক্তি যিনি ইফতার করতে ও সালাত আদায় করতে দেরী করতেন, তিনি ছিলেন আবূ মূসা। (মুসলিম)[1]

[1] সহীহ : মুসলিম ১০৯৯, আবূ দাঊদ ২৩৫৪, তিরমিযী ৭০২, নাসায়ী ২১৬১, আহমাদ ২৪২১২।

অত্র হাদিস প্রমাণ করে, তাড়াতাড়ি ইফতার করা নামাজ আদায় করা রাসূল  (সা) এর সুন্নাহ ছিল


ü রাসূল সা বলেছেন !

وَعَنْ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِذَا أَقْبَلَ اللَّيْل من هَهُنَا وَأدبر النَّهَار من هَهُنَا وَغَرَبَتِ الشَّمْسُ فَقَدْ أَفْطَرَ الصَّائِمُ»

 

 উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন ওদিক থেকে রাত (পূর্বদিক হতে রাতের কালো রেখা) নেমে আসে, আর এদিক থেকে (পশ্চিম দিকে) দিন চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়, তখনই সায়িম (রোযাদার) ইফতার করে।   (বুখারী, মুসলিম)[1]

[1] সহীহ : বুখারী ১৯৫৪, মুসলিম ১১০০, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৫৯৫, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৯৪১, আহমাদ ১৯২, আবূ দাঊদ ২৩৫১, তিরমিযী ৬৯৮, ইবনু খুযায়মাহ্ ২০৫৮, ইবনু হিব্বান ৩৫১৩, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮০০৪, ইরওয়া ৯১৬, সহীহ আল জামি ৩৬৪।

অত্র হাদিস প্রমাণ করে, সূর্য অস্তমিত হওয়া মাত্রই ইফতার করতে হবে বিলম্ব করা যাবে না


ü মানুষেরা কল্যাণের উপর থাকবে!

عن سهل بن سعد رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال‏:‏ ‏

‏لا يزال الناس بخير ما عجلوا الفطر‏"

‏متفق عليه‏

হযরত সাহল বিন সা' ( রাঃ ) হতে বর্ণিত৷ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা ইরশাদ করেছেন, মানুষ ততদিন কল্যাণের সাথে থাকবে যতদিন তারা ইফতার শাঘ্র শীঘ্র করবে

{ বুখারী মুসলিম , ( মিশকাত, বাংলা তৃতীয় খন্ড হাঃ নং 1887, ,কু প্রকাশনী ) }

অত্র হাদিস প্রমাণ করে, তাড়াতাড়ি ইফতার করা কল্যাণ পাওয়ার মাধ্যম


 v দীনকে বিজয়ী রাখা ইহুদী-নাসারাদের স্বভাব ত্যাগ করা


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لِأَنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُونَ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَابْن مَاجَه

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দীন সর্বদাই বিজয়ী থাকবে (ততদিন), যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। কারণ ইয়াহূদী ও খৃষ্টানরা ইফতার করতে বিলম্ব করে। (আবূ দাঊদ, ইবনু মাজাহ)[1]

[1] হাসান : আবূ দাঊদ ২৩৫৩, ইবনু মাজাহ ১৬৯৮, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৯৪৪, ইবনু খুযায়মাহ্ ২০৬০, ইবনু হিব্বান ৩৫০৩, শুআবূল ঈমান ৩৯১৬, আহমাদ ৯৮১০, মুসতাদারাক লিল হাকিম ১৫৭৩, সহীহ আত্ তারগীব ১০৭৫, সহীহ আল জামি ৭৬৮৯। 

অত্র হাদিস দ্বারা বুঝা যায় যে, দীনকে জয়যুক্ত রাখতে চাইলে তাড়াতাড়ি ইফতার করতে হবে এবং ইহুদী-নাসারাদের ন্যায় বিলম্বে ইফতার করা যাবে না


ü  রাসূল সাঃ এর সুন্নাত সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা তিনি এত তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন যে , অনেক সময় সাহাবীগণ বলতেন, হে আল্লাহর রাসূল, সন্ধা হোক না, এখনো তো দিন শেষ হলো না তিনি বলতেন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করতে হবে

     ( খুৎবাতুল ইসলাম, ,আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ ( 287 পৃ )

 

v কিভাবে জানবো -- সূর্য কখন অস্ত যায় ??

পূর্বরোল্লিখিত আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম যে , সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতে হবে আর এতে মানবজাতীর কল্যাণ নিহিত রয়েছে যে কোন ইবাদত করার পূর্বে সেটাকে সাধ্যানুযায়ী যাচাই-বাচাই করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে ইফতার করাও একটা ইবাদত। স্থানের ভিন্নতা অনুযায়ী সূর্য অস্তমিত হওয়ার সময়ের মাঝেও ভিন্নতা রয়েছে। তাই এবিষয়েও যাচাই-বাচাই করতে হবে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এবিশাল পৃথিবীর কোথায় , কখন সূর্য ঢুবে এটা আমরা কিভাবে জানবো ?

 হ্যাঁ, প্রযুক্তির কল্যাণে সারা পৃথিবী এখন আমাদের হাতের মুঠোয় এসেছে প্রতি মুহুর্তে পৃথিবীর  কোনো প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুব সহজে জানা যাচ্ছে৷

তাই, এখন আর সূর্য ঢুবার সঠিক সময় নিয়ে সন্দের অবকাশ নেই

বর্তমানে অনেকের কাছেই স্মার্ট ফোন আছে উক্ত ফোন থেকে "Google" গিয়ে "sunset here" লিখে সার্চ দিলেই জানা যাবে এলাকায় কখন সূর্য অস্তমিত হবে


v আহবান =

প্রিয় পাঠকগণ ! আমরা সবাই এক আল্লাহর বান্দা এবং নবী মুহাম্মাদ  সাঃ এর উম্মত যেকোন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে আল্লাহ এবং নবী  সাঃ  এর ফয়সালা মেনে নিতে হবে কোন রকম ওযর-আপত্তি করা যাবে না না জানার কারণে যা করেছি সেগুলো আল্লাহ  তায়ালা ক্ষমা করবেন

 কিন্তু কোন বিষয়ে স্পস্ট প্রমাণ পাওয়ার পর সেটাকে অগ্রাহ্য করা বা এড়িয়ে চলা মুসলিমের চরিত্র হতে পারে না তাই আসুন সকল প্রকার সংকীর্ণতাকে পরিহার করে কুরআন-সুন্নাহর নিকট নিজেকে সমর্পণ করি আল্লাহ তায়া আমাদেরকে সঠিক বুঝদান করুন

আমীন!



 


No comments

Powered by Blogger.