সমাজে প্রচলিত কুরবানী সংক্রান্ত কতিপয় ভুল-ত্রুটি


 সমাজে প্রচলিত কুরবানী সংক্রান্ত কতিপয় ভুল-ত্রুটি

 এই সংক্ষিপ্ত লেখায় আমরা সমাজে প্রচলিত কুরবানী সংক্রান্ত কতিপয় ভুল-ত্রুটি আলোকপাত করার ইচ্ছা করেছি, যেন এই ইবাদতটি আমরা সঠিক ভাবে সম্পাদন করতে পারি এবং ভুল-ত্রুটি থেকে দূরে থেকে পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হতে পারি।

-কুরবানীর উদ্দেশ্যে ভুলঃ 
কুরবানী একটি ইবাদত কারণ মহান আল্লাহ তা পছন্দ করেন এবং আমাদের তা করার আদেশ দেন। আল্লাহ বলেন:

فَصَلِّ لِرَبِّکَ وَ انۡحَرۡ

(তাই তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে স্বলাত পড় এবং কুরবানী কর।)  [সূরা কাউসার/]

 এই রকম প্রত্যেক ইবাদত কবুলের প্রথম শর্ত হল, ইবাদতে ইখলাস থাকা। অর্থাৎ ইবাদতটি খাঁটি ভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হওয়া। তাই কুরবানী করার উদ্দেশ্য হবে শরীয়া নির্দিষ্ট পশু নির্দিষ্ট সময়ে জবাই করার মাধ্যমে আল্লাহকে রাযী-খুশী করা। কিন্তু তিক্ত সত্য হচ্ছে সমাজের বহু লোক কুরবানী দেয় গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে, যা তাদের কথা-বার্তায় অনেক সময় প্রকাশও পায়। তারা বলে: কুরবানী না দিলে গ্রাম-সমাজের লোকেরা কি বলবে! সেদিন সবাই গোশত খাবে আর আমার বাচ্চা-কাচ্চারা কি খাবে! আর অনেকে দেয় সমাজে প্রসিদ্ধ হবার উদ্দেশ্যে নাম পাবার আশায়। তাই বাজারের সেরা পশু ক্রয় করে পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে বা প্রচারের আশা করে। অথচ আল্লাহ বলেন:

لَنْ يَنَالَ اللَّـهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَـٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ

অর্থ: আল্লাহর কাছে ঐসবের গোশত এবং রক্ত পৌঁছে না বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহ ভীরুতা) [আল হজ্জ/৩৭]

-অনেক সামর্থবান ব্যক্তি কুরবানী তো করে কিন্তু ফরয ইবাদত হজ্জকে বেমালুম ভুলে যায়ঃ 
যিল
হজ্জ মাসের ১০ম তারিখ যেদিন কুরবানীর দিন সেদিন কিন্তু হজ্জেরও বিশেষ দিন। প্রত্যেক সামর্থবান মুসলিমের প্রতি হজ্জ করা ফরয। কিন্তু এমন অনেকে আছে যারা প্রতি বছর কুরবানী তো ধুমধামের সাথে করে থাকে কিন্তু তাদের উপর হজ্জ করা যে জরুরি তা বেমালুম ভুলে যায়।

 আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ

আল্লাহর জন্য উক্ত ঘরের হজ্জ করা লোকদের উপর আবশ্যক যার সে পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে আর যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, (সে জেনে রাখুক) নিঃসন্দেহে আল্লাহ জগৎ সমূহের প্রতি অমুখাপেক্ষী।”[আল ইমরান/৯৭]

৩-যিল হজ্জ তথা কুরবানীর মাসের প্রথম দশকের বিভিন্ন ফযীলত উপেক্ষা করে শুধু কুরবানী করতে আগ্রহী হওয়াঃ

উল্লেখ্য যে, যিল হজ্জ মাসের ১ম দশক খুবই ফযীলতপূর্ণ দশক। অনেক উলামার মতে, আল্লাহর নিকট যিল হজ্জ মাসের প্রথম দশকের দিনের সৎ আমল সমূহ রামাযানের শেষ দশকের দিনের ইবাদতের থেকেও উত্তম। [শারহুল্ মুমতি, ইবনু উছায়মীন,/৪৭০] 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ কোনো এমন দিন নেই, যাতে এই দশকের তুলনায় সৎ আমল আল্লাহর নিকট বেশী পছন্দনীয়। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেনঃ আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও কি বেশী পছন্দনীয় নয়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও বেশী পছন্দনীয় নয় কিন্তু সেই ব্যক্তি যে তার জান মাল নিয়ে বের হয় এবং তা নিয়ে আর পুনরায় ফেরত আসে না [বুখারী, দুই ঈদ অধ্যায়, নং (৯৬৯)/আবু দাঊদ নং (২৪৩৮)]

উপরোক্ত হাদীসের মর্মার্থ ব্যাপক, তাই সকল ধরণের সৎ আমল এই দশকে বেশী বেশী করণীয়। 

যেমন,

ক. হজ্জ উমরাহ। কারণ এটি হজ্জের মাস এবং উক্ত আমল দুটির ফযীলতও অপরিসীম।  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

العمرة الي العمرة كفارة لمابينهما والحج المبرور ليس له جزاء الا الجنة

 এক উমরা আর এক উমরার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের কাফ্ফারা স্বরূপ। আর (মাবরূর) গৃহীত হজ্জের বদলা জান্নাত ছাড়া কিছু নয় [বুখারী, নং ১৭৭৩ মুসলিম নং ১৩৪৯]

খ. সিয়াম পালন। যেহেতু হাদীসে সৎ আমল কথাটি ব্যাপক আর রোযা হচ্ছে সৎ আমল, তাই অনেকে এই দশকের প্রথম থেকে নবম দিন পর্যন্ত রোযা পালন উত্তম মনে করেছেন। [ শারহু মুসলিম, নবভী, /৭৫]

বিশেষ করে আরাফার দিনে। কারণ আরাফার দিনের রোযা বিগত আগত এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা স্বরূপ।

صيام يوم عرفة احتسب علي الله ان يكفر السنة التي قبلها والسنة التي بعدها

আমি আল্লাহর নিকট আশা করি আরাফার দিনের সিয়াম পূর্বের ও পরের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা হবে।  [মুসলিম, নং ১১৬২]

গ. এই দশকে তাকবীর পাঠ করা। [বিস্তারিত এই পয়েন্টের পরে]

ঘ. কুরবানী করা।

ঙ. দুআ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর-আযকার, সাদাকা, আত্মীয়তা বজায় রাখা ইত্যদি।

কিন্তু আমদের অনেকেই উপরোক্ত আমল সমূহের প্রতি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে কেবল কুরবানী করার জন্য, পশু ক্রয় করা তা কুরবানী দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকি!

-এই পুরো দশকে সাধারণতঃ এবং তাশরীকের দিন গুলিতে ফরয নামাযান্তে বিশেষ করে তাকবীর পড়ার সুন্নতকে অবহেলা করাঃ

এই দিনগুলি হচ্ছে বিশেষ করে আল্লাহকে স্বরণ করার দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তাই এতে বেশী বেশী তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) এবং তাহমীদ (আল্ হামদুলিল্লাহ) পাঠ কর [আহমদ, নং ৬১৫৪, আহমদ শাকির সহীহ বলেছেন]

 অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “এগুলি পানাহার এবং আল্লাহর যিকরের দিন [আবু দাঊদ (২৪১৯, নাসাঈ ৩৯৯৫)

এই ১৩ দিনে দুই ধরণের তাকবীর পাঠ সুন্নাহ:

একটি হলঃ সাধারণ তাকবীর পাঠ, যা ১ম যিল হজ্জ থেকে ১৩ই যিল হজ্জের সূর্য ডোবা পর্যন্ত যে কোনো সময় পাঠ করা সুন্নাহ।

আর একটি হলোঃ মুক্বায়্যাদ (শর্তযুক্ত) তাকবীর পাঠ। আর তা হচ্ছে, প্রত্যেক ফরয নামাযান্তে তাকবীর পাঠ যা, আরাফার দিন ফজর নামাযের পর থেকে শুরু হয়ে ১৩ই যুল হজ্জের আসর নামায পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। (এটা তাদের জন্য যারা হজ্জ পালনকারী নয়) আর হাজীদের ক্ষেত্রে এই মুক্বায়্যাদ তাকবীর কুরবানীর দিন যোহর থেকে শুরু হবে এবং তাশরীকের শেষ দিন আসর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। [মাজমুউ ফাতাওয়া,২৪/২৫৩, মুলাখ্খাস আল ফিকহী, ১৩২-১৩৩]

একাধিক সাহাবা থেকে এই তাকবীরের শব্দগুলি প্রমাণিত, তন্মধ্যেঃ

-  الله اكبر  الله اكبر  الله اكبر كبيرة  (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার কাবীরা।)  [বায়হাক্বী,/৩১৬, ফাতহুল বারী, /৪৬২]

-  الله اكبر  الله اكبر  لا اله الا الله    والله اكبر    الله اكبر ولله الحمد    ( আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।)  [মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা (৫৬৩৩)]

- الله اكبر كبيرة  الله اكبر كبيرة  الله اكبر واجل   الله اكبر ولله الحمد   আল্লাহু আকবার কাবীরা, আল্লাহু আকবার কাবীরা, আল্লাহু আকবার ওয়া আজাল্ল, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। [মুসান্নাফ নং (৫৬৪৬)]

এই দশকে ইবনু উমার আবু হুরাইরা (রাযিঃ) বাজারে বের হতেন, তারা তাকবীর দিতেন এবং অন্য লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীর পড়তেন। [বুখারী, ঈদাইন অধ্যায়, তালীকান]

আজ আমাদের সমাজে এই সুন্নাহ মৃতপ্রায়। আমাদের এই সুন্নাহ পুনর্জীবিত করার সচেষ্ট হওয়া উচিৎ।

-যে ব্যক্তি কুরবানী করার নিয়ত করেছে এবং যিল হজ্জ মাসের চাঁদ দেখা দিয়েছে এমন ব্যক্তির কুরবানী না করা পর্যন্ত চুল, চামড়া নোখ কাটা থেকে বিরত না থাকা:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

‏ مَنْ كَانَ لَهُ ذِبْحٌ يَذْبَحُهُ فَإِذَا أُهِلَّ هِلاَلُ ذِي الْحِجَّةِ فَلاَ يَأْخُذَنَّ مِنْ شَعْرِهِ وَلاَ مِنْ أَظْفَارِهِ شَيْئًا حَتَّى يُضَحِّيَ ‏"‏ ‏.‏

যে লোকের কাছে কুরবানীর পশু আছে সে যেন যিলহজ্জের নতুন চাঁদ দেখার পর ঈদের দিন থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে। (সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৯৫৯ ইসলামিক সেন্টার ৪৯৬৫)

তাই যে ভাই কুরবানী করতে চায়, সে যেন উপরে বর্ণিত কোনো কিছু না কাটে। কিন্তু যে নিজে কুরবানীদাতা নয় বরং তার পক্ষ থেকে বাড়ির গার্জিয়ান দেয়, যেমন ধরুন পরিবারের সদস্যরা তাহলে তারাও কি উপরের আদেশের অন্তর্ভুক্ত?

শাইখ ইবনে উসায়মীন (রাহেঃ) মনে করেনঃ উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা কেবল তার জন্য যে স্বয়ং কুরবানী দাতা আর যাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় তাদের উপর সে সব কর্তন করা অবৈধ নয়। তিনি মনে করেনঃ হাদীসে নিষেধাজ্ঞা স্বরূপ যেই সম্বোধন রয়েছে তা দ্বারা কেবল তাকে বুঝানো হয়েছে, যে প্রকৃতপক্ষে কুরবানীদাতা আর যাদের পক্ষ থেকে  কুরবানী দেওয়া হয়, তারা এই সম্বোধনের অন্তর্ভুক্ত নয়। [ শারহুল মুমতি, /৪৮৬-৪৮৭]

আবার এমনও লোক দেখা যায়, যারা কুরবানী করতে ইচ্ছুক তাই এই দশকে দাড়ি কাটে না কিন্তু কুরবানী করার পর দাড়ি কেটে ফেলে। এমন লোকের জানা উচিৎ যে, দাড়ি সব সময় রাখাই হচ্ছে মুমিনের কর্তব্য। তা এই দশকে রেখে সওয়াব পাওয়ার আশা করা অযৌক্তিক। অতঃপর কুরবানীর সাথে সাথে দাড়ির কুরবানী একটি শরীয়ত গর্হিত কাজ।

-এই দশকে রক্ত প্রবাহ করা বা রক্ত দেখা নিষেধ মনে করা: 
কিছু
সমাজে এমনও ধারণা আছে যে, যিল হজ্জ মাসের চাঁদ উঠলে কোনো পশু যবাই করা যাবে না বা রক্ত দেখা যাবে না; যতক্ষণ কুরবানী না দেওয়া হয়। এই কারণে সেই সময় তাদের বাড়িতে মেহমান আসলে তারা মুরগী, ছাগল, গরু ইত্যাদি জবেহ করে মেহমানের আপ্যায়ন না করে গোশত ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা আপ্যায়ন করে থাকে। মনে রাখা উচিৎ, হালাল পশু-পাখি সাধারণ লোকদের জন্য সব সময় হালাল। এই দশকে রক্ত প্রবাহ করা যাবে না-মর্মে শরীয়ায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আর শরীয়া যা নিষেধ করেনি তা নিষেধ মনে করাও নিষেধ।

-গরু বা উটে ভাগে কুরবানী করাকে সফরের সাথে নির্দিষ্ট মনে করাঃ 
উট গরুতে শরীক হয়ে কুরবানী দেওয়া প্রমাণিত।

عن جابر بن عبد الله، قال: حججنا مع رسول الله صلى الله عليه و سلم، فنحرنا البعير عن سبعة، والبقرة عن سبعة. 

আবদুল্লার পুত্র জাবির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হজ্জ করলাম। অতঃপর সাত জনের পক্ষে একটি উট নহর করলাম এবং সাত জনের পক্ষে একটি গাভী। [মুসলিম, অধ্যায়, হাজ্জ, অনুচ্ছেদ নং ৬২, হাদীস নং ৩৫১]

কিন্তু এই রকম ভাগে কুরবানী দেওয়াটা কেবল সফরের সাথে নির্দিষ্ট আর মুকীম অর্থাৎ নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারীরা ভাগে কুরবানী দিতে পারে না মনে করা একটি ভুল ফতোয়া। এমন পার্থক্য না তো হাদীস থেকে বুঝা যায় আর না কোনো সালাফ এমন বলেছেন আর না মুহাদ্দিস ফুকাহাগণ করেছেন। তাই এই বিষয়ে এমন পার্থক্য করা একটি অভিনব সালাফদের জ্ঞান বুঝের বিপরীত ফতোয়া। ফুকাহাদের মধ্যে কেবল লাইস এমন মন্তব্য করলে ইবনু হাযম বলেনঃ এবং লাইস সফরে কুরবানীতে শরীক হওয়া বৈধ মনে করেন। আর এটা এমন তাখসীস/নির্দিষ্টকরণ যার কোন অর্থ হয় না [আল্ মুহাল্লা,/৩৮১]

প্রকাশ থাকে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যাবতীয় কথা কাজ আম তথা ব্যাপক অর্থ বহন করে, যতক্ষণ তা কোনো কিছুর সাথে নির্দিষ্ট না করা হয়।

এটা প্রমাণিত যে, ইসলামে মুসাফিরের জন্য কিছু বিধানে কতিপয় ছাড় সুবিধা রয়েছে, যেমন সফর অবস্থায় নামায কসর করা, জুমআর নামায ফরজ না হওয়া, রোযা ছেড়ে দেয়া, মোজার উপর মাসাহ করার সময়-সীমা মুকীমের তুলনায় বেশী থাকা ইত্যাদি। জাতীয় যে সব বিষয়ে মুসাফিরের জন্য বিশেষ ছাড় রয়েছে তা আমাদের পূর্ববর্তী উলামা ফকীহগণ বর্ণনা করে গেছেন কিন্তু তারা কেউই ভাগা কুরবানীকে সফরের বিধানের মধ্যে উল্লেখ করেন নি আর না এমন বলেছেন যে, মুসাফিরদের জন্য ছাড় হল যে, তারা ভাগা কুরবানী দিতে পারে।

-উট কিংবা গরু কুরবানী দেওয়ার সময় সাত ভাগের কোনো ভাগে আক্বীকা উদ্দেশ্য করা:

আক্বীকা একটি এমন ইবাদত, যার সময় নির্ধারিত আর তা হচ্ছে বাচ্চার জন্মের সপ্তম দিন। আর এক হাসান হাদীস অনুযায়ী সাত তারিখে না পারলে ১৪ তারিখে আর তাতেও সম্ভব না হলে ২১ তারিখে। [স্বাহীহুল জামি আস্ স্বগীর ৪০১১]

এই ভাবে কুরবানীর সময়ও নির্ধারিত আর তা হল, যিল হজ্জ মাসের ১০ তারিখ এবং ১১, ১২ ১৩ তরিখ। যে সব ইবাদত বিশেষ দিন তারিখের সাথে সম্পর্কিত তা অন্য দিনে করলে বিদআত অগ্রহণীয় বিবেচিত হবে। তাই উপরোক্ত তারিখ ছাড়া অন্য দিনে কুরবানী দিলে কুরবানী হবে না; কারণ কুরবানীর দিন তারিখ শরীয়া কর্তৃক নির্ধারিত। এই ভাবে আক্বীকার দিন-তারিখও নির্ধারিত, তাহলে তা সেই সময়ে না করলে অন্য দিনে করলে কি ভাবে কবুল হতে পারে?  শরীয়ত কি কারণ ছাড়াই সেই সময় নির্ধারণ করেছেন?  অন্যদিকে যারা সেই নির্ধারিত সময়ে আক্বীকা না দিয়ে কুরবানীর দিনে কুরবানীর ভাগে আক্বীকা দেয়, তারা তাদের সন্তানের আক্বীকা দিতে আন্তরিক তো, না সুযোগের অপব্যবহার করে, কোনোরূপে দায়ভার থেকে মুক্তির চেষ্টা করে?

যারা এই বলে কুরবানীর ভাগায় আক্বীকা দেওয়ার পক্ষপাতী যে, দুটিই নৈকট্যের কাজ তাই একত্রে দেওয়া যায়। তাদের মনে রাখা উচিৎ যে, এমন মন্তব্য দলীলের মুকাবিলায় একটি কিয়াস/অনুমান, যা পরিত্যাজ্য এবং এটাও মনে রাখা উচিৎ যে, কোনও কাজ শুধু নৈকট্যের হলেই গ্রহণীয় হয় না যতক্ষণে তা নবীর তরীকায় সম্পাদন না করা হয়। আর কুরবানীর সাথে আক্বীকা দেওয়া নবীর তরীকা নয়।

-এমন মনে করা যে, একটি ছাগল কিংবা একটি ভেড়ার কুরবানী কেবল এক জনের পক্ষ থেকে হয়; একটি পরিবারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয় না:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ছাগল কুরবানী দিয়েছেন এবং সাহাবাগণও একটি ছাগল নিজ নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে যবাই করতেন, তাতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা যাই হোক না কেন। আবু আইয়্যুব আনসারী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূল সা. এর যুগে

كَانَ الرَّجُلُ يُضَحِّي بِالشَّاةِ عَنْهُ وَعَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ فَيَأْكُلُونَ وَيُطْعِمُونَ حَتَّى تَبَاهَى النَّاسُ فَصَارَتْ كَمَا تَرَى

মানুষ তার তার বাড়ির সদস্যদের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানী করতেন, নিজে খেতেন এবং অপরকে খাওয়াতেন [ তিরমিযী, আযাহী অধ্যায়, নং (১৫০৫)/ইবনু মাজাহ ]

উল্লেখ্য যে, সবচেয়ে উত্তম কুরবানী হচ্ছে, একটি পূর্ণ উটের কুরবানী অতঃপর একটি পূর্ণ গরুর কুরবানী অতঃপর একটি পূর্ণ ছাগল কিংবা ভেড়ার কুরবানী অতঃপর উট কিংবা গরুর এক অংশের কুরবানী। [মুগনী ১৩/৩৬৬]

-মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা:

  এই প্রসঙ্গটির কয়েকটি দিক রয়েছেঃ

- কোনো মৃতের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্ররূপে একটি আলাদাই কুরবানী দেওয়া। যেমন, একটি ছাগল বা গরু বা গরু কিংবা উটের কোনো বিশেষ এক-দুই ভাগ মৃতের জন্য দেয়া। মৃতের জন্য এমন স্বতন্ত্র কুরবানী বৈধ নয়। সত্যিকারে কুরবানীর সুন্নতটি জীবিতদের জন্য এটা মৃতদের জন্য নয়। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত প্রিয়া স্ত্রী খাদীজা (রাযিঃ), তাঁর মৃত প্রিয় চাচা হামযা (রাযিঃ) এবং মৃত প্রিয় সন্তানাদির কারোর পক্ষ থেকে কুরবানী দেন নি। বরং তিনি নিজের নিজ পরিবারে পক্ষ থেকে কুরবানী দিতেন।

- এমন ব্যক্তি যে কাউকে মৃত্যুর পূর্বে অসীয়ত করে যায় যে, সে মারা গেলে তার পক্ষ থেকে যেন সে কুরবানী দেয়, তাহলে সেই মৃত ব্যক্তির অসীয়ত অনুযায়ী এবং তার অসীয়ত বাস্তবায়নে কুরবানী করা বৈধ। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَمَنۡۢ بَدَّلَهٗ بَعۡدَ مَا سَمِعَهٗ فَاِنَّمَاۤ اِثۡمُهٗ عَلَی الَّذِیۡنَ یُبَدِّلُوۡنَهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

অতঃপর যে ব্যক্তি তা শুনার পর অসীয়তে পরিবর্তন ঘটাবে, তবে তার গুনাহ তাদেরই উপর বর্তাবে, যারা তার পরিবর্তন ঘটাবে। [সূরা বাক্বারা/১৮১]

আলী (রাযীঃ) হতে প্রমাণিত রয়েছে যে, তিনি দুটি ভেড়া কুরবানী দেন এবং বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অসীয়ত করে গেছেন যেন আমি তার পক্ষ থেকে কুরবানী দেই, তাই আমি তার পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়ে থাকি [ আবু দাঊদ, তিরমিযী, হাদীটিকে শাইখ আলবানী যয়ীফ বলেছেন ]

- জীবিতদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়ার সময় পরিবারের মৃতদেরও সওয়াবে ভাগিদার করার নিয়ত করা। এমন করা একটি বিতর্কিত বিষয়। কেউ এটাকে বৈধ বলেন আর কেউ অবৈধ। বৈধতার পক্ষে দলীল হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানী দিতেন বলতেনঃ হে আল্লাহ! এটা মুহাম্মদের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মদের পরিবারের পক্ষ থেকে [মুসলিম] অথচ পরিবারের অনেকেই ইতিপূর্বে মৃত্যু বরণ করেছিল। আর যারা অবৈধ মনে করেন, তাদের নিকট দলীলটি স্পষ্ট নয় এবং তার পরে খুলাফায়ে রাশেদীন থেকে এমন করা প্রমাণিত নয়। [শারহুল মুমতি /৪৭৯-৪৮০]

১০-কুরবানীর সময় শুধু ১০ম যিল হজ্জকে মনে করাঃ

কুরবানীর সময় ১০ম যিল হজ্জে ঈদের নামায সমাপ্ত হলে শুরু হয় এবং তাশরীকের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ যিল হজ্জের সূর্যাস্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। যদিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ম তারিখেই কুরবানী করতেন কিন্তু তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এও বলেছেনঃ এবং তাশরীকের সমস্ত দিন কুরবানীর দিন [আহমদ, স্বহীহুল জামি, আলবানী নং ৪৫৩৭]

তাই কোনো ব্যক্তি যদি ১০ম যিল হজ্জে কোনো কারণে কুরবানী না করতে পারে তাহলে, তাশরীকের যে কোনো দিনে কুরবানী করতে পারে।

১১-কুরবানীর পশু ক্রয় করার পর যদি তা দোষ যুক্ত হয়ে যায় (যেমন লেংড়া হয়ে যায়, কানা হয়ে যায়..) কিংবা মারা যায় কিংবা হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তাহলে তার পরিবর্তে কুরবানী দেওয়া জরুরি মনে করা:

উপরের বিষয়গুলি যদি কুরবানীদাতার অবহেলায় তার কারণে ঘটে। যেমন সেই পশুকে এমন ভাবে প্রহার করেছে যে, পা ভেঙ্গে গেছে বা চোখ অন্ধ হয়ে গেছে কিংবা খোলা মাঠে ছেড়ে রেখেছে তাই হারিয়ে গেছে কিংবা যেখানে মানুষ রাতে পশু রাখে সেখানে না রেখে গোয়াল ঘরের বাইরে খোলা স্থানে বেঁধে রাখার কারণে চুরি হয়ে গেছে কিংবা এমন উঁচু স্থানে বেঁধে রেখেছে যেখান থেকে পড়ার আশংকা ছিল, তাই পড়ে মারা গেছে , তাহলে তাকে তার পরিবর্তে অন্য কুরবানী দেওয়া জরুরি। আর যদি তা তার অবহেলায় না ঘটে বরং সে দোষ হীন পশু ক্রয় করেছিল কিন্তু ক্রয় করার পর দোষ যুক্ত হয়েছে, তাহলে তার উপর এর বদলে অন্য কুরবানী জরুরি নয়, সেটা দিলেই যথেষ্ট হবে। এই পার্থক্যের কারণ হল, কোনও পশু যখন কুরবানীর নিয়তে ক্রয় করা হয়, তখন সেটা কুরবানী করা পর্যন্ত তার কাছে আমানত হিসাবে থাকে। আর আমানতের বিধান হল, যদি আমানতদার নিজ অবহেলায় আমানত নষ্ট করে তাহলে তার উপর জামানত/দণ্ড জরুরি হয়। আর যদি তার অবহেলায় তা নষ্ট না হয়, তাহলে তার উপর দণ্ড জরুরি হয় না। [আল মুগনী,১৩/৩৭৩, শারহুল মুমতি,/৪৭৫-৪৭৬]

১২-অমুসলিমকে কুরবানীর গোশত দেওয়া অবৈধ বা অপছন্দ মনে করাঃ

অমুসলিমকে তার অভাবের কারণে, প্রতিবেশী হওয়ার কারণে এমনকি তার মন জয় করার উদ্দেশ্যে তাকে কুরবানীর গোশত দান করা বা সাদাকা করা বৈধ।হ্যাঁ, তবে সে যদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হয়, তাহলে তার বিধান ভিন্ন। [সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদের ফতোয়া ১১/৪২৪]

১৩-জেনে-বুঝে দোষ যুক্ত পশু ক্রয় করাঃ

চার প্রকার দোষ ওয়ালা পশুর কুরবানী বৈধ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ চার প্রকার (দোষ থাকলে) কুরবানীতে বৈধ নয় অন্য বর্ণনার শব্দে এসেছে যথেষ্ট নয় স্পষ্ট টেরা, স্পষ্ট রোগা, স্পষ্ট খোঁড়া, অতি দুর্বল (অতি বয়সের কারণে মজ্জাহীন হাড় ওয়ালা) [ আবু দাঊদ নং ২৮০২, তিরমিযী নং ১৪৯৭, নাসাঈ ৪৩৬৯ ]

এই দলীলের আলোকে এটাও বুঝা যায় যে, যেই পশুর দোষ এর থেকেও বেশী বড় সেসব পশুর কুরবানীও নাজায়েয। যেমন অন্ধ, পা ভাঙ্গা, চলতে অক্ষম ইত্যাদি।

উপরোক্ত দলীলের আলোকে এটাও বুঝা যায় যে, বর্ণিত দোষ থেকে নিম্ন পর্যায়ের দোষ থাকলে তার কুরবানী বৈধ কিন্তু উত্তম নয়। যেমন কান কাটা, শিং ভাঙ্গা, লেজ কাটা, চামড়া কাটা পশু। এমন দোষ থাকলে তা কুরবানীতে মাকরূহ।

এর পরেও অনেককে দেখা যায়, কিছু মানুষ স্পষ্ট খোঁড়া বা একেবারে বয়স্ক পশু কুরবানীর জন্য খরীদ করে!

১৪-কুরবানী জবাই করা সংক্রান্ত ভুল সমূহঃ

. নিজে যবাই না করে অন্যের মাধ্যমে যবাই করা; অথচ কুরবানী একটি ইবাদত আর ইবাদত নিজে করা বেশী ভাল। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে কুরবানী করতেন। তবে কেউ যদি যবাই করতে ভয় পায় বা ছুরি চালাতে না জনে তাহলে তার বিধান ভিন্ন।

. অযু ছাড়া যবাই না করা; অথচ যবাই করার জন্য অযু না তো জরুরি আর না মুস্তাহাব। তাই যবাইয়ের উদ্দেশ্যে অযু জরুরি বা মুস্তাহাব মনে করা বিদআহ। [ সউদী স্থায়ী ফতোয়া কমিটি, ১১/৪৩৩-৪৩৫]

. কুরবানীর পশুর সামনে ছুরি-চাকু ধার দেওয়া, পশুর সামনে উন্মুক্ত ভাবে তা ধারণ করা, এক অপরের সামনে যবাই করা, যবাই করার পর নিস্তেজ না হতেই চামড়া ছাড়ানো শুরু করা এবং নির্মম ভাবে যবাই করা মারূহ। [ হাকেম, ত্বাবারানী, আহমদ, ইবনু মাজাহ (৩১৭২ )]

. অন্যের কুরবানী যবাই করার সময় তাঁদের নাম লেখা তা কুরবানীর পশু যবাই করার পূর্বে পড়া জরুরি মনে করা। যেমন, বলা যে এই গরুতে জনের নাম দেন। মনে রাখা উচিৎ, যে বা যারা কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশুটি ক্রয় করেছে এবং যত ভাগ কুরবানী দেয়ার নিয়ত করেছে, তার সেই নিয়ত অনুযায়ী সে বদলা পাবে এবং তার নিয়ত আল্লাহ অবশ্যই জানেন। এখন অন্য কোনো ব্যক্তি যদি তাদের কুরবানীটা যবাই করে দেয়, তাহলে সে শুধু কুরবানীদাতার পক্ষ থেকে যবাই করার কাজের প্রতিনিধি মাত্র। বিদায় হজ্জে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রকম ষাটাধিক সাহাবীর কুরবানী করেছিলেন, তাতে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নাম জিজ্ঞেস করেন নি যে, এটা কার কার পক্ষ থেকে, এই উটে তোমরা কতজন শরীক রয়েছো, নাম উল্লেখ কর, ইত্যাদি। বরং তিনি সাধারণ ভাবে যবাই করে গেছেন। তবে এটাও প্রমাণিত যে, তিনি অনেক ক্ষেত্রে যবাই করার পর বলতেনঃ এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের মধ্যে তাদের পক্ষ থেকে যারা কুরবানী দেয় নি [ আহমদ, আবু দাঊদ, তিরমিযী ]

তাই যার কুরবানী অন্য যবাই করছে, সে যবাই দেয়ার সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবারের পর তার নাম বলতে পারে যে এটা অমুক বা অমুক অমুকের পক্ষ থেকে। কিন্তু যবাই করার পূর্বে তা বলার নিয়ম নেই।

. কুরবানী দাতা সে একটি পূর্ণ পশু কুরবানী দিক বা ভাগা কুরবানী দিক কুরবানী দেওয়ার সময় সে তা নিজ পরিবারের সকলের পক্ষ থেকে নিয়ত করবে। অর্থাৎ সেই কুরবানীর সওয়াব সকলে পাক, তা নিয়ত করবে।

যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাগল কুরবানী দেওয়ার পর বলেনঃ হে আল্লাহ! এটা মুহাম্মদ, মুহাম্মদের পরিবার এবং মুহাম্মদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবূল কর [ আহমদ, মুসলিম ]

এখন যারা প্রতি ভাগে একটা করে নাম নেয়, তারা বুঝাতে চায় যে, এটি এক জনের পক্ষ থেকেই হচ্ছে অন্যরা এর সওয়াব পাবে না; অথচ কুরবানীদাতা তার কুরবানীতে নিজ নিজ পরিবার সকলের সওয়াব কামনা করবে, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করতেন।

. কুরবানীর পশু যবাই করার জন্য বিশেষ কোনো দুআ আছে মনে করা। অথচ সাধারণ পশু যবাই করার সময় যেমন আল্লাহর নাম নেওয়া জরুরি তেমন কুরবানীতেও তাই জরুরি। তাই বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলে যবাই করলেই হয়ে গেল। যবাই করার পূর্বে (ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া) বলা যবাই শেষে (আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল) বলা মুস্তাব, জরুরি নয়।

. ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলে পশুর গলার চামড়া কেটে দিয়ে কশাইকে বাকি যবাই সম্পন্ন করতে দেওয়া। এটি আসলে কশাইর মাধ্যমে যবাই করা গণ্য হবে। কারণ শারঈ যবাই তখন হবে যখন, পশুর শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এর দুই পাশের মোটা রগ দুটি কর্তন করা হবে। আর এখানে যবাইকারী ব্যক্তি শুধু চামড়া কাটে আর প্রকৃতপক্ষে যবাইর কাজ কশাই করে। অন্য দিকে এই সময় কশাই সাধারণতঃ আল্লাহর নাম নেয় না।

. কশাইকে কুরবানীর গোশত দেওয়া নিষেধ বলতে কশাইকে কাজের মজুরি স্বরূপ দেওয়া নিষেধ বুঝায়। সে তার মজুরি হিসাবে টাকা কিংবা অন্য কিছু নিতে পারে। কিন্তু কুরবানীর গোশত যেমন অন্যকে দান হিসেবে দেয়া মুস্তাহাব তেমন তাকেও দেওয়া মুস্তাহাব।

. কুরবানী যবাই করার পর পশুর রক্ত, গোবর, হাড়, চামড়া প্রভৃতি মাটির উপর যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যাতে দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং মানুষের কষ্ট হয় এমনকি পশুদেরও কষ্ট হয়।

১৫-কুরবানীর গোশত জরুরি ভিত্তিক তিন ভাগে বিভক্ত করে সমাজকে বিতরণ করতে দেওয়া:

কিছু সমাজে জরুরি ভিত্তিক এমন নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছে যে, তাদের গ্রামে বা সমাজে যারাই কুরবানী দিবে, তাদেরকে অবশ্যই তাদের কুরবানীর গোশত তিন ভাগে বিভক্ত করতে হবে। অতঃপর এক ভাগ যতক্ষণ সামাজে জমা না দেওয়া হয় ততক্ষণ তারা বাড়িতে গোশত নিয়ে যেতে পারবে না বা এই ধরণের অন্য নিয়ম।

প্রথমতঃ শরীয়া কুরবানীর গোশতকে তিন ভাগে বিভক্ত করা জরুরি করে নি। তোমরা নিজে খাও, অপরকে খাওয়াও এবং জমা রাখ [বুখারী, আযাহী, নং ৫৫৬৯]

এবং অন্য হাদীস তোমরা নিজে খাও, জমা রাখ এবং দান কর [ মুসলিম নং ১৯৭১]

এই হাদীসদ্বয়ের মাধ্যমে কুরবানীর গোশতের খাত বুঝা যায়, তা আবশ্যিক ভাবে তিনভাগে বিভক্ত করা বুঝায় না।

দ্বিতীয়তঃ “অপরকে খাওয়াও বা সাদাকা কর সম্বোধনটি প্রত্যেক কুরবানীদাতাকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছে; সমাজ নেতাদের নয়। তাই কুরবানী দাতা নিজে কুরবানীর গোশতের বণ্টন করবে-এটাই হাদীসের মর্ম। কিন্তু সমাজ বিতরণ করার দায়িত্ব নিলে তাদের জন্য এটা বৈধ; তবে জরুরি নয়।

এই সামাজিক নিয়মের সমস্যা হল, তারা জোরপূর্বক মানুষের কাছ থেকে কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক জমা দেয়ার নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়। অথচ সাদাকা দান আল্লাহর উদ্দেশ্যে খাঁটি মনে স্বেচ্ছায় না দিলে কবুল হয় না। অনুরূপ কারও কাছ থেকে কোনো কিছু জোরপূর্বক নেওয়া এবং তা দান করাও নিষেধ। তাই এই নিয়মে সাদাকা কারীর ইখলাস আন্তরিকতা থাকে না বরং থাকে সামাজিকতার অবৈধ চাপ।

এই আবশ্যপালনীয় সামাজিক নিয়মের আর একটি সমস্যা হল, সমাজ যখন কুরবানীর গোশত জমা করে বিতরণ করে, তখন বিভিন্ন গ্রামের ফকির-মিসকিন উপস্থিত হয় এবং তাদের ভাগ্যে আসে দু-চার গ্রাম গোশত। তাই তাকে সেই দিনে আবারও ভিক্ষা করার ন্যায় ঘুরতে হয় পাঁ দশ গ্রাম। অথচ প্রত্যেক গ্রামে কুরবানীদাতা স্বয়ং যদি তার আশেপাশে বসবাসকারী পরিচিতদের দুই-চার জনকে গোশত বিতরণ করে এই ভাবে অন্যরাও বিতরণ করে তাহলে গ্রামের  সকল অভাবীর বাসায় গোশত পৌঁছে যাবে। তাদেরকে সে দিন লজ্জা, কষ্ট, তিরষ্কার মাথায় নিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।

আরো একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে যা আমরা অনেকে অনুভব করি না। তা হল, অনেকে একটি ছাগল বা একটি গরুর ভাগ কুরবানী দেয়। তারা খুব বেশী হলে /১০ কেজির গোশত পায়। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ বা আধা যদি সমাজিক নিয়মের কারণে তাদের দিতে হয়, তাহলে তার কাছে অবশিষ্ট থাকে - কে.জি. এখন বাড়িতে-- জন সদস্য সংখ্যা হলে অনুমান করুন তো তারা দু বেলা তৃপ্তি সহকারে গোশত খেতে পারবে কি? তারা নিজ আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের দিতে পারবে কি? তাই এমন বহু লোক ভারাক্রান্ত মনে সমাজের নির্ধারিত অংশ জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে। অথচ এই দিনগুলি পানাহারের দিন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তাশরীকের দিনগুলি খান-পান আল্লাহর যিকরের দিন [ মুসলিম, নং ১১৪১]

তাই তারা প্রথমে আনন্দ করে খাবে এটা ঈদুল আযহার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। অতঃপর অন্যকেও দিবে। এমন লোক কুরবানী দাতা হলেও তাদের কুরবানীর গোশত হাদিয়া স্বরূপ দেওয়া উচিৎ।

১৬-কুরবানীর চামড়া বিক্রয় করাঃ

উল্লেখ্য যে, কুরবানীর পশুর সব কিছুই আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তাই তার কোনো অংশ বিক্রয় নিষেধ। যেমন তার গোশত বিক্রয় নিষেধ তেমন তার চামড়া বিক্রি করাও নিষেধ।  

আলী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা কুরবানীর উটের দায়িত্ব দেন এবং আদেশ করেন, যেন আমি সেই উটের গোশত, চামড়া, পরিধেয়, সাদাকা/দান করে দেই এবং কশাইকে তা থেকে কিছু না দেই [ মুসলিম নং ১৩১৭]

তাই স্বয়ং কুরবানীদাতা কুরবানীর চামড়া দ্বারা উপকৃত হবে কিংবা ফকীর মিসকীনকে দান করে দিবে কিংবা কাউকে হাদিয়া করে দিবে। এটাই হবে চামড়ার সঠিক খাদ। কিন্তু যদি সমাজের অবস্থা এমন হয় যে, স্বয়ং কুরবানী দাতা তা ব্যবহার করতে জানে না কিংবা ফকীর মিসকীনরাও চামড়া নেয় না, তাহলে কি করণীয়?

এমতাবস্থায় কুরবানীর চামড়া নষ্ট না করে যদি তা বিক্রয় করে অন্যকে দান করা হয়, তাহলে এটা প্রয়োজনার্থে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ যার মূল্য রয়েছে তা একেবারে নষ্ট করে দেয়ার চাইতে উপকৃত হওয়া ভাল। তাছাড়া এই ক্ষেত্রে কুরবানীদাতা স্বয়ং সেই চামড়ার মূল্য ভক্ষণকারী নয়; বরং সে সেই মূল্য সাদাকাকারী। হাসান, নাখঈ, আওযায়ী এবং ইমাম আবু হানীফা (রাহেঃ) কুরবানীর চামড়া বিক্রয় করার পক্ষে মত দিয়েছেন এবং ইবনে উমার (রাযিঃ) এর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি চামড়া বিক্রি করতেন এবং তার মূল্য সাদাকা করতেন। [ মুগনী, ইবনু কুদামাহ ১৩/৩৮২]

উল্লেখ্য যে, কুরবানীর চামড়ার মূল্যের খাত ব্যাপক। কারণ তা সাধারণ সাদাকার অন্তর্ভূক্ত। তাই তা ফকির, মিসকিনকে দেয়া সহ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় যে কোনও সওয়াবের খাতে ব্যবহার করা যাবে।

আল্লাহই ভাল জানেন ।

কপি

 

 

 

No comments

Powered by Blogger.