অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলিমদের অংশগ্রহণ ও শুভেচ্ছা জানানোর বিধান

 



প্রশ্ন: কোনো মুসলিমের জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা মণ্ডপে  যাওয়া কি জায়েজ ?   

কেউ যদি সেখানে যায় তাহলে কি সে কাফের হয়ে যাবে বা বেঈমান হয়ে মারা যাবে ?  এবং এতে কি তার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে ?
উত্তর:
কোন মুসলিমের জন্য কেবল আনন্দ-উপভোগের উদ্দেশ্যে বিধর্মীদের দেব-দেবতা, মূর্তি ইত্যাদি দেখতে যাওয়া বা অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করা অথবা তাদেরকে ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতা করা জায়েজ নেই।  তা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য কোন ধর্মের হোক না কেন।


নিম্নে এর দশটি কারণ  উল্লেখ করা হল:

 . বিধর্মীদের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করা বা তাদের দেবদেবী মূর্তি দর্শনের উদ্দেশ্যে তাদের উপাসনালয়ে যাওয়া তাদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন এর শামিল- যা ইসলামে নিষিদ্ধ। কেননা এগুলো অমুসলিমদের বৈশিষ্ট্য; মুসলিমদের নয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
যে ব্যক্তি অন্য সম্প্রদায়ের (বিধর্মীদের) সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদেরই দলভুক্ত।

 [ সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০৩১, সহীহুল জামে-আলবানী হা/২৮৩১ ]

. এর মাধ্যমে দৃশ্যত: কা ফি -মু রি কদের দল ভারী করা হয়- যা ইসলামে নিষিদ্ধ।

. যে উৎসবে শিরকের মত আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত এবং ক্রোধ উদ্রেক কারী কার্যক্রম সংঘটিত হয় সেখানে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাজিল হয়।

উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলতেন,

اجْتَنِبُوا أَعْدَاءَ اللهِ ـ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى ـ فِي عِيدِهِمْ يَوْمَ جَمْعِهِمْ؛ فَإِنَّ السَّخَطَ يَنْزِلُ عَلَيْهِمْ فَأَخْشَى أَنْ يُصِيبَكُمْ
তোমরা আল্লাহর দুশমন ইহুদি-খৃষ্টানদের উৎসবসমূহে তাদের থেকে দূরে থাক। কারণ তাদের উপর আল্লাহর অসন্তোষ অবতীর্ণ হয়। ফলে আশঙ্কা আছে যে, তোমরাও তাতে আক্রান্ত হবে। [বায়হাকী-আস-সুনান আল-কুবরা, /২৩৪; দেখুন: কানযুল উম্মাল, হাদীস নং- ১৭৩২]

সুতরাং আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাজিলের স্থানে কোন মুসলিমের বেড়াতে যাওয়া বা  আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠা মোটেও সমীচীন নয়। কেননা এতে তারা আল্লাহর অসন্তোষ, শাস্তি ক্রোধের রোষানলে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

 . সকল কপোল কল্পিত দেব-দেবতা বা কথিত উপাস্যদের মূর্তি প্রতিকৃতি তৈরি এবং সেগুলোর উপাসনা করা তাদের নিজদের বানোয়াট, মনগড়া অর্থহীন কাজ ছাড়া কিছু নয়।
সুতরাং এই সকল বানোয়াট অসার জিনিস দেখতে যাওয়া কোন তাওহিদপন্থী মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, 

وَٱلَّذِينَ لَا يَشۡهَدُونَ ٱلزُّورَ وَإِذَا مَرُّواْ بِٱللَّغۡوِ مَرُّواْ كِرَامٗا

আর যারা মিথ্যার সাক্ষ্য হয় না এবং অসার কার্যকলাপের সম্মুখীন হলে আপন মর্যাদা রক্ষার্থে তা পরিহার করে চলে

 [সূরা আল ফুরকান: ৭২]
কতিপয় মুফাসসিরের মতে, আয়াতে মিথ্যা বলতে মুশরিকদের উৎসব বুঝানো হয়েছে।

 . হিন্দুদের পূজামণ্ডপ, বৌদ্ধদের প্যাগোডা বা খৃষ্টানদের গির্জায় গিয়ে তাদের দেব-দেবতা শিরকী কার্যক্রম দেখে আনন্দ উপভোগ করলে অন্তর থেকে শিরক আল্লাহর নাফরমানি মূলক কার্যক্রমের প্রতি ঘৃণা বোধ চলে যাওয়ার এবং এসব হারাম কর্মের প্রতিবাদের মানসিকতা দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

. এর ফলে কাফেরদের ধর্মীয় রীতি-নীতি দ্বারা অন্তর প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার পরিণতি খুব ভয়াবহ। বিশেষ করে দুর্বল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তির অন্তরে তাদের ধর্মের প্রতি ভালোবাসা আকর্ষণ বোধ তৈরি হতে পারে। এমনকি কারণে তার ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

 . বিধর্মীদের উৎসব, পর্ব এবং উপাসনালয়গুলোতে শিরকের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পাশাপাশি সাধারণত: গান-বাদ্য, বেপর্দা নারীদের অবস্থান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, মদ পান, গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ পশু বলি ইত্যাদি নানা ধরণের হারাম কর্ম সংঘটিত হয়। সুতরাং এমন পাপ পূর্ণ ও‌ নোংরা পরিবেশে কোন আত্ম মর্যাদাসম্পন্ন মুমিনের যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

তবে অন্তরে আল্লাহ, রাসূল দীন ইসলামের প্রতি মজবুত ঈমান থাকলে এবং নিজেকে সকল ফেতনা থেকে নিরাপদ মনে করলে আল্লাহর সাথে শিরকের ভয়াবহ রূপ স্বচক্ষে দর্শন করে শিক্ষালাভ করত: মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে অথবা এই অন্যায়ের প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে কিংবা অমুসলমিদেরকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে যদি কোন ইমানদার ব্যক্তি সেখানে যায় তাহলে তা না জায়েজ নয়।

অনুরূপভাবে কোন ইমানদার ব্যক্তি যদি দীনহীন বন্ধু-বান্ধবের প্ররোচনায় পড়ে বা কু প্রবৃত্তির টানে সেখানে যায় তাহলে তার জন্য আবশ্যক হল, অনতিবিলম্বে সেখান থেকে ফিরে আসা এবং আল্লাহর নিকট লজ্জিত অন্তরে তওবা করা। কিন্তু কারণে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে না এবং তাদের দাম্পত্য জীবনেও তার কোন প্রভাব পড়বে না ইনশাআল্লাহ। কারণ আল্লাহর প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে।

. আরেকটি বিষয় হল, অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলিমদের ভিড় করার ফলে তাদের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। অনেক সময় তারা নিরাপত্তা হীনতায় ভোগে। কারণ কিছু দুর্বৃত্ত এই সুযোগে সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা করে এবং স্বার্থান্বেষীরা পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে থাকে যা বহু ঘটনা থেকে প্রমাণিত।
সুতরাং অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবের দিন তারা যেন নির্বিঘ্নে নিরাপদে তাদের ধর্মাচার্য পালন করতে পারে সে জন্য সেদিন মুসলিমদের সেখানে ভিড় করা মোটেও উচিৎ নয়।

 ১০. অনুরূপভাবে বিধর্মীদেরকে তাদের ধর্মীয় উৎসব পালনে সাহায্য-সহযোগিতা করা জায়েজ নয়। কারণ তা মূলত: আল্লাহ দ্রোহিতা সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতার শামিল যা আল্লাহ তাআলা নিষিদ্ধ করেছেন।

তিনি বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّـهَ ۖ إِنَّ اللَّـهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
আর সৎকর্ম আল্লাহ ভীতিতে একে অন্যের সহায়তা কর। পাপ সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তি দাতা।

[সূরা মায়িদা: ]

মোটকথা, মুসলিমদের জন্য বিধর্মীদের দেব-দেবী দেখে শুধু আনন্দ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে তাদের উপাসনালয়ে গমন করা বা তাদের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করা, উপলক্ষে পরস্পরে শুভেচ্ছা বিনিময় করা এবং এসব কাজে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম। অথচ আমাদের দেশের একশ্রেণীর তথাকথিত প্রগতিবাদী নামধারী মুসলিম বক ধার্মিক ব্যক্তিরা ধর্ম যার যার উৎসব সবার এই যুক্তিহীন ভ্রান্ত স্লোগানের আড়ালে মুসলিমদেরকে এমন হারাম শিরকী কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করে। এর চেয়েও বড় ভয়াবহ বিষয় যে, এরা নিজেরাও অনেক সময় দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে পূজায় অংশ গ্রহণ করে থাকে। সত্যি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভবিষ্যতবাণী বর্তমানে বাস্তবায়িত হয়েছে।

তিনি বলেছেন,

لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي بِالْمُشْرِكِينَ وَحَتَّى يَعْبُدُوا الْأَوْثَانَ
আমার উম্মতের একদল লোক মুশরিকদের সাথে মিলিত হওয়ার পূর্বে এবং মূর্তি পূজায় লিপ্ত হওয়ার পূর্বে কিয়ামত সংঘটিত হবেনা।

[বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল মানাকিব]

উল্লেখ্য যে, কোনও মুসলিম যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও ধর্মকে অধিক উত্তম, সমপর্যায়ের অথবা সঠিক বলে বিশ্বাস করে তাহলে সে ইসলামের গণ্ডী থেকে বের হয়ে যাবে (মুরতাদ হয়ে যাবে) কারণ দীন-ইসলাম হচ্ছে বিশ্ব মানবতার জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট একমাত্র মনোনীত গ্রহণীয় জীবন ব্যবস্থার নাম। ইসলাম ছাড়া যত ধর্ম এবং মতাদর্শ রয়েছে সবই বাতিল-মিথ্যা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّـهِ الْإِسْلَامُ
আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) ইসলাম।

[সূরা আলে ইমরান: ১৯]
তিনি আরও বলেন,

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু (ধর্ম/মতাদর্শ) অনুসন্ধান করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে ক্ষতি গ্রস্ত।

[সূরা আলে ইমরান: ৮৫]

পরিশেষে দুআ করি, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের নির্বোধদের কারণে আমাদেরকে তার শাস্তির হাত থেকে হেফাজত করুন, অজ্ঞদেরকে কে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান সুবুদ্ধি দান করুন এবং আমাদেরকে হেদায়েতের উপর অটল রাখুন মৃত্যু অবধি। আমীন।

আল্লাহু আলাম-আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।
▬▬▬
❂◍▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।।

 বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই কপি করলাম। 

সংকলনে,

এইচ,এম,হুজ্জাতুল্লাহ

  (বি.টি.আইএস - অনার্স   এম.টি.আই.এস - মাস্টার্স ) - আল-হাদীস বিভাগ,

  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কুষ্টিয়া

No comments

Powered by Blogger.