মুসলিম জীবনে কুরবানীর গুরুত্ব ও তৎপর্য

alorbhuban.blogspot.com

মুসলিম জীবনে কুরবানীর গুরুত্ব ও তৎপর্য


কুরবানীর ইতিহাস:

আদি পিতা আদম আ. এর দুই পুত্র কাবীল হাবীলের দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। আদম আলাইহিস সালাম হতে প্রত্যেক নবীর যুগে কুরবানী করার ব্যবস্থা ছিল।

যেমন ইরশাদ হয়েছে :

وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ

আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে।

[সূরা আল-হাজ্জ: ৩৪]

وَٱتۡلُ عَلَيۡهِمۡ نَبَأَ ٱبۡنَيۡ ءَادَمَ بِٱلۡحَقِّ إِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانٗا فَتُقُبِّلَ مِنۡ أَحَدِهِمَا وَلَمۡ يُتَقَبَّلۡ مِنَ ٱلۡأٓخَرِ

আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর একজন থেকে গ্রহণ করা হলো আর অপরজনের থেকে গ্রহণ করা হলো না। 

[সূরা আল-মায়িদাহ:৩৪]

উম্মতে মোহাম্মদীর কুরবানীর সূচনা ..........

আমাদের উপর যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম আ. কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল আ. কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণেসুন্নাতে ইবরাহীমীহিসাবে চালু হয়েছে। মক্কা নগরীর জনমানবহীনমিনাপ্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম ইসমাঈল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছেঈদুল আযহাবা কুরবানীর ঈদ। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের প্রকৃষ্ট নমুনা এই কুরবানীতে প্রতীয়মান।

আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বন্ধু ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছেন এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তার রবের কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, আমি তোমাকে নেতা বানাবো’।

 [সূরা আল-বাকারাহ-১২৪]

নিজ পুত্র যবেহ করার মত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখিন হয়েছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। বিষয়ে সূরা আস-সাফ্ফাতের ১০০ থেকে ১০৯ আয়াতে বলা হয়েছে,

رَبِّ هَبۡ لِي مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ١٠٠ فَبَشَّرۡنَٰهُ بِغُلَٰمٍ حَلِيمٖ ١٠١ فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعۡيَ قَالَ يَٰبُنَيَّ إِنِّيٓ أَرَىٰ فِي ٱلۡمَنَامِ أَنِّيٓ أَذۡبَحُكَ فَٱنظُرۡ مَاذَا تَرَىٰۚ قَالَ يَٰٓأَبَتِ ٱفۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُۖ سَتَجِدُنِيٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٠٢ فَلَمَّآ أَسۡلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلۡجَبِينِ ١٠٣ وَنَٰدَيۡنَٰهُ أَن يَٰٓإِبۡرَٰهِيمُ ١٠٤ قَدۡ صَدَّقۡتَ ٱلرُّءۡيَآۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجۡزِي ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٠٥ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ ٱلۡبَلَٰٓؤُاْ ٱلۡمُبِينُ ١٠٦ وَفَدَيۡنَٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِيمٖ ١٠٧ وَتَرَكۡنَا عَلَيۡهِ فِي ٱلۡأٓخِرِينَ ١٠٨ سَلَٰمٌ عَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِيمَ ١٠٩

অর্থ: তিনি বললেন, হে প্রভু! আমাকে নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম এক অতীব ধৈর্যশীল সন্তানের। পরে যখন সে সন্তান তার সাথে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানোর বয়সে পৌঁছলো তখন তিনি (ইবরাহীম আ:) একদিন বললেন, হে বৎস ! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাকে যবেহ করছি এখন তুমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখ এবং তোমার অভিমত কী? তিনি (ইসমাঈল) বললেন, হে পিতা আপনি তাই করুন যা করতে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন । ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অতঃপর যখন দু’জনই আল্লাহর আদেশ মানতে রাজি হলেন, তখন তিনি (ইবরাহীম আ.) পুত্রকে যবেহ করার জন্য শুইয়ে দিলেন। আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম ! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই নেক বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি বড় পরীক্ষা। আর আমি তাকে বিনিময় করে দিলাম এক বড় কুরবানীর দ্বারা এবং তা পরবর্তীর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহীম (আ.) এর উপর।”

একমাত্র আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় এবং আল্লাহ প্রদত্ত কঠিনতম পরীক্ষায় সাফল্যজনকভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে এক মহান পিতার প্রাণাধিক পুত্রকে কুরবানী করার মধ্য দিয়ে ধৈর্যশীলতার উত্তম নমুনা পেশ পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।

 কুরআন মাজীদে উল্লেখিত আয়াতসমূহে ইবরাহীম ইসমাঈল আলাইহিমুস সালামের আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি সীমাহীন আনুগত্যের সাবলীল বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।

কুরবানীর পরিচয়:

কুরআন মাজিদে কুরবানীর বদলেকুরবানশব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাদীছেওকুরবানীশব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে এর পরিবর্তেউযহিয়াহযাহিয়াপ্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর এজন্যই কুরবানীর ঈদকেঈদুল আযহাবলা হয়। আরবীকুরবানশব্দটি ফারসী বা উর্দূতেকুরবানীরূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থনৈকট্য

পারিভাষিক অর্থেকুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়।

 প্রচলিত অর্থে, ঈদুল আযহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ তরীকায় যে পশু যবহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়’।

কুরবানীর গুরুত্ব

. কুরবানী আল্লাহ তাআলার অন্যতম নিদর্শন।

আয়াতে আল্লাহ বলেন-

وَٱلۡبُدۡنَ جَعَلۡنَٰهَا لَكُم مِّن شَعَٰٓئِرِ ٱللَّهِ لَكُمۡ فِيهَا خَيۡرٞۖ فَٱذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَيۡهَا صَوَآفَّۖ فَإِذَا وَجَبَتۡ جُنُوبُهَا فَكُلُواْ مِنۡهَا وَأَطۡعِمُواْ ٱلۡقَانِعَ وَٱلۡمُعۡتَرَّۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرۡنَٰهَا لَكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ

কুরবানীর উটসমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম করেছি। তোমাদের জন্য যাতে কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থা এগুলোর উপর তোমরা আল্লাহর নাম স্মরণ করো আর যখন কাত হয়ে পড়ে যায় তখন সেগুলো হতে খাও। আর আহার করাও ধৈর্য্যশীল অভাবী ও ভিক্ষাকারী অভাবগ্রস্তকে এভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”

সুরা হাজ্জ  - ৩৬

. পশু দ্বারা কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর যিকির বা স্মরণের বাস্তবায়ন হয়ে থাকে।

প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :

وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ

আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। 

সূরা আল-হাজ্জ: ৩৪

. ইসলামে হাজ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইবাদত। হজ্জের সাথে কুরবানীর অনেক বিষয় জড়িত। 

হাজীগণ দিনে তাদের পশু যবেহ করে হজ্জকে পূর্ণ করেন। জন্য এর নাম হল (يَوْمُ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ) বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন।

হাদীসে এসেছে, ইবন উমর রাদিয়াল্লাহুআনহু বলেন,

«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَفَ يَوْمَ النَّحْرِ بَيْنَ الْجَمَرَاتِ فِي الْحَجَّةِ الَّتِي حَجَّ فَقَالَ أَيُّ يَوْمٍ هَذَا قَالُوا يَوْمُ النَّحْرِ قَالَ هَذَا يَوْمُ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ»

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন দিন? সাহাবাগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন্নাহর বা কুরবানির দিন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা হলো ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবার বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন।

 [সুনান আবু দাউদ]

. কুরবানীর মাধ্যমে সামাজিক পারিবারিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়।

সমাজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রেরণা তৈরি হয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا وَلَا تَفَرَّقُواْۚ

তোমারা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।

 সূরা আলে ইমরান : ১০৩

. কুরবানীতে গরীব মানুষের অনেক উপকার হয়।

 যারা বছরে একবারও গোশত্ খেতে পারে না, তারাও গোশত্ খাবার সুযোগ পায়। দারিদ্র বিমোচনেও এর গুরুত্ব রয়েছে। কুরবানীর চামড়ার টাকা গরীবের মাঝে বণ্টন করার মাধ্যমে গরীব-দুখী মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। অপরদিকে কুরবানীর চামড়া অর্থনীতিতে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে।

কুরবানীর বিধান।

কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন:

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ

তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।

[সূরা আল-কাউসার : ]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا

যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে। 

[মুসনাদ আহমাদ, ইবন মাজাহ- ৩১২৩ হাদীসটি হাসান]

যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি হাদীস একটি সতর্কবাণী।

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّة

হে লোক সকল, প্রত্যেক পরিবারের উপর কুরবানী দেয়া অপরিহার্য।”

 [সুনান ইবন মাজাহ-৩১২৫, হাদীসটি হাসান]

উল্লেখিত আলোচনা থেকে অনেকে বলেছেন যে,, কুরবানী করা ওয়াজিব। তবে অনেক ওলামায়ে কিরাম কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলেছেন।

লোকেরা যাতে এটাকে ওয়াজিব মনে না করে, সেজন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আবু বকর ছিদ্দীক, ওমর ফারূক, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. প্রমুখ সাহাবী কখনো কখনো কুরবানী করতেন না।

বায়হাক্বী, ইরওয়াউল গালীল হা/১১৩৯; মির‘আত ৫/৭২-৭৩।

অতএব ঋণ থাকলে সেটা পরিশোধ করাই যরূরী। তবে দাতার সম্মতিতে ঋণ দেরীতে পরিশোধ করে কুরবানী দেওয়ায় কোন বাধা নেই।

কুরবানীর উদ্দেশ্য:

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার ইবাদত করার জন্য। তাই আল্লাহ তাআলার বিধান তাঁর নির্দেশিত পথে পালন করতে হবে।

তিনি বলেন :

وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ

আমি জিন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা শুধু আমার ইবাদত করবে।

 [সূরা আয্যারিয়াত-৫৬]

কুরবানীর উদ্দেশ্যে হলো -

. শর্তহীন আনুগত্য

আল্লাহ তাআলা তার বান্দাহকে যে কোনো আদেশ দেয়ার ইখতিয়ার রাখেন এবং বান্দাহ তা পালন করতে বাধ্য। তাই তার আনুগত্য হবে শর্তহীন। আল্লাহর আদেশ সহজ হোক আর কঠিন হোক তা পালন করার বিষয়ে একই মন-মানসিকতা থাকতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে মায়া-মমতা প্রতিবন্ধক হতে পারে না। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন।

জন্য মহান আল্লাহ যেভাবে বিশ্ব মানবমন্ডলীকে বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করেছেন ঠিক সেভাবে সর্বশেষ জাতি হিসেবে মুসলিম জাতির পিতাও মনোনয়ন দিয়েছেন

কুরআনে এসেছে :

مِّلَّةَ أَبِيكُمۡ إِبۡرَٰهِيمَۚ هُوَ سَمَّىٰكُمُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ

এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত;তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।’ 

[সূরা আলহাজ্জ : ৭৮]

২. তাকওয়া অর্জন

তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ   

আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।

 [সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭]

৩. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা

প্রত্যেক ইবাদাতই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। তাই কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ

এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে। 

[সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭]

৪. ত্যাগ করার মহান পরীক্ষা

কুরবানীর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ত্যাগ করার মানসিকতা তৈরী করা। আল্লাহর বিধান পালনে জান-মালের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কুরবানীর ঈদকে গোশত খাওয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত করা নয়, বরং নিজেদের মধ্যকার পশুসুলভ আচরণ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নফসের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়াই কুরবানীর উদ্দেশ্য।

وَلَنَبۡلُوَنَّكُم بِشَيۡءٖ مِّنَ ٱلۡخَوۡفِ وَٱلۡجُوعِ وَنَقۡصٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِۗ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ

আমি তোমাদেরকে অবশ্যই ভয়, দারিদ্র্য, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতি করার মাধ্যমে পরীক্ষা করবো।’

 [সূরা আল-বাকারাহ: ১৫৫]

৫। বিশ্বব্যাপী আল্লাহ একত্ববাদ তথা তাওহীদ প্রতিষ্ঠা:

কুরবানী মূলতঃ পবিত্র হজ্জের আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে অংশ বিশেষ। হাজী সাহেব আরাফার ময়দানে যিলহাজ্জ মাসে উপস্থিত হয়ে কুরবানী করার মাধ্যমে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন। একই সময়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বেও কুরবানী করা হয়ে থাকে। তাই মহান আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নামেই পশু কুরবানী দেয়া হয়। সর্বত্রই তখন মুখরিত হয় 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনীতে।

৬। অধীনস্তদের দ্বীনের পথে পরিচালিত করা:

কুরবানী আমাদেরকে শিক্ষা দেয়, শুধু নিজে আল্লাহর বিধান করলে চলবেনা। নিজের অধীনস্তদেরকেও আল্লাহর বিধান মানতে বলতে হবে। তাদেরকে মানতে বাধ্য করতে হবে, অন্যথায় ধর-পাকড় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবেনা। নবীজি বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই তার অধীনস্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। ইবরাহীম আঃ তার ছেলেকে জবেহ করতে আদিষ্ট হয়েছিলেন। আদেশটা ছিল তার ছেলে সম্পর্কে। যদি ইসলাম শুধু ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে জবাই করার মত বিষয় নবী হয়ে ইবরাহীম আঃ আদেশ পালন করতেন না। অথচ তিনি বিনা সংশয়ে আদেশ পালন করেছেন। এর থেকে বুঝা যায়, ব্যক্তির ক্ষেত্রে তো বটেই, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ের ইসলামি বিধানও পালন করতে হবে। পরিবার ও সমাজকে আল্লাহর বিধানের দাওয়াত দিতে হবে, চাপ প্রয়োগ করতে হবে। সংশয় ছাড়াই। অন্যথায় দায়িত্বশীলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

৭। পরামর্শ ভিত্তিক জীবন যাপন:

কুরবানী আমাদেরকে পরামর্শভিত্তিক জীবন যাপনে শিক্ষা দেয়। আসলে আমরা যেমন বলেছি, ইসলাম ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তো, ইসলাম কীভাবে সমাজ পরিচালনা করতে চায়? সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলাম সাম্য, সামাজিকতা ও আলাপ-আলোচনার গুরুত্ব দেয়। কেননা এই সুযোগ না দিলে, পরিণামে, ব্যক্তিতন্ত্র কায়েম হয়। অথচ ইসলাম বলে, সবাই আল্লাহর বান্দা, আর কারো বান্দা নয়। অতএব, আল্লাহর সাথে মানুষের বন্দেগির সম্পর্ক, মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভাতৃত্বের। ইবরাহীম আঃ ইসমাইল আঃকে জবেহ করার বিষয়ে দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি নবী, আদেশ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তবুও, প্রয়োগের আগে তিনি ছেলের অনুমতি নিয়েছেন "বাবা আমি তো স্বপ্নে দেখেছি, আল্লাহ আদেশ করেছেন, যাতে তোমাকে জবাই করি, তুমি কি বল বাবা?” এই তো দায়িত্বশীলদের অধীনস্তদের সাথে সম্পর্ক, অনুমতি ও পরামর্শ!

৮। সহমর্মিতা:

কুরবানী আমাদেরকে ভ্রাতৃত্ব ও সহমির্মতার শিক্ষা দেয়। এই জন্য পবিত্র কুরআনেও কুরবানী গোশত দরিদ্র অভাবী মানুষদের মাঝে বিতরণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যাতে করে সমাজের মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। আল্লাহ তায়লা বলেন-

لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ، فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ [٢٢:٢٨]

যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্থকে আহার করাও। 

(সুরা হজ্জ- ২২:২৮)

৯। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা:

অনেক প্রগতিশীল তথা নাস্তিক্যবাদী অজ্ঞরা বলে থাকেন এক সাথে এত পশু নিধনে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাই পশু নিধন না করে এর অর্থ গরীব দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করলেই হয়। এভাবে তারা পশুর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে চায়। অথচ আল্লাহর বিধান হলো মানুষ হালাল জন্তুর গোশত ভক্ষন করবে। আর সৃষ্টিকূলের মধ্যেও এ নিয়মই চালু আছে। যেমন- বাঘ শিয়াল খায়, শিয়াল মোরগ খায়, মোরগ পোকা খায়, আবার পোকা গাছের পাতা খায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এইভাবেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা আল্লাহর প্রাকৃতিক নিয়ম। সেজন্য কোন প্রাণীর খাদ্য কি হবে সেটা আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এখন আপনি পোকা কে নিষেধ করতে পারবেন না যে তুমি গাছের পাতা খেয়ো না। আল্লাহ আমাদের নির্দেশ করেছেন পশু কুরবানী করতে, তাই আমরা কুরবানী করি। এভাবেই কুরবানীর মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়।

 কুরবানীর পশু :

 এটা তিন প্রকার- উট, গরু ছাগল। দুম্বা ভেড়া ছাগলের মধ্যে গণ্য। প্রত্যেকটির নর মাদি। এগুলির বাইরে অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ সা. সাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায় না। তবে অনেক বিদ্বান গরুর উপরে ক্বিয়াস করে মহিষ দ্বারা কুরবানী জায়েয বলেছেন।

আনআম ১৪৪-৪৫; মিরআত /৮১ পৃঃ।

ইমাম শাফেঈ রহ. বলেন, ‘উপরে বর্ণিত পশুগুলি ব্যতীত অন্য কোন পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হবে না

কিতাবুল উম্ম (বৈরূত : ছাপাঃ তারিখ বিহীন) /২২৩ পৃঃ।

কুরবানীর পশু সুঠাম, সুন্দর নিখুঁত তে হবে। চার ধরনের পশু কুরবানী করা নাজায়েয। যথা- স্পষ্ট খোঁড়া, স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট রোগী জীর্ণশীর্ণ এবং অর্ধেক কান কাটা বা ছিদ্র করা অর্ধেক শিং ভাঙ্গা।

মুওয়াত্ত্বা, তিরমিযী প্রভৃতি মিশকাত হা/১৪৬৫, ১৪৬৩, ১৪৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯২) /৩০ পৃঃ।

তবে নিখুঁত পশু ক্রয়ের পর যদি নতুন করে খুঁৎ হয় বা পুরানো কোন দোষ বেরিয়ে আসে, তাহলে পশু দ্বারাই কুরবানী বৈধ হবে

মিরআত /৯৯ পৃঃ

বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে ট্যাবলেট বা খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করা পশু দেখতে যত সুন্দরই হৌক, জেনেশুনে তা কিনলে তাতে কুরবানী হবে না। পরে জানলেও তা বাদ দেওয়া উচিৎ। কেননা ঐসব বিষাক্ত পশুর গোশত ফরমালিনের মত মানুষকে নীরবে হত্যা করে। এতে মানুষ লিভার, কিডনী, ক্যান্সার হৃদরোগসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। এইসব গরুর হাড়ের ভিতরকার মজ্জা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর। পশুর দেহ বিষাক্ত করার পর বাকী বিষের সবটুকু মজ্জায় গিয়ে জমা হয়।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তোমরা ক্ষতি করো না ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না 

(আবুদাঊদ)

তিনি বলেন, যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।

 (মুসলিম)

উল্লেখ্য যে, খাসি করা কোন খুঁৎ নয় এবং খাসি কুরবানীতে শরীআতে কোন বাধা নেই। রাসূল সা. নিজে খাসি কুরবানী করেছেন।

ইবনু মাজাহ হা/৩১২২, ইরওয়া হা/১১৩৮, সনদ ছহীহ।

কুরবানী কবুলের শর্তাবলী

ইখলাছ:

যে কোন আমল কবুলের পূর্ব শত ইখলাছ তথা বিশুদ্ধ নিয়াত। কারণ নিয়াতের উপর আমলের ফর নির্ভরশী। আমরা কি উদ্দেশ্যে কুরবানী করবো একমাত্র আল্লাহ-ই তা জানেন। তাই সবার আগে আমাদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। উমর ইবনুল খাত্তাব থেকে বর্ণিত আমি রাসূলুল্লাহ্ (১) বলেন- প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। (সহীহুল বুখারী, ওয়াহয়ীর সূচনা অধ্যায়, হাদিস: ১ (ইফা)

হালাল মাল দ্বারা কুরবানী করা:

যেহেতু যে কোন ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত হালাল মাল তাই আমাদের কুরবানীসহ সকল ইবাদত কবুল হওয়াতেও সঙ্গত কারণে হালাল উপার্জন প্রথম শর্ত। তাই আমাদেরকে যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য হালাল উপায়ে উপার্জিত অর্থের খাবার, পোষাক ও শরীর গঠিত হতে হবে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ (১) বলেন-"হে লোক সকল আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করে না। 

(সহীহ মুসলিম (ইফাঃ), যাকাত অধ্যায়, হাদিস নং- ২২১৮)

কুরবানীর ফযিলাত

. কুরবানীর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জিত হয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ

আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত,পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্ম পরায়ণদেরকে।”

[সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭]

২. কুরবানীর প্রবাহিত রক্ত আল্লাহ তাআলার কাছে দুটি কুচকুচে কালো ছাগলের চেয়ে প্রিয় পবিত্র।

প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

دَمُ عَفْرَاءَ أَحَبُّ إلى الله مِنْ دَمِ سَوْدَاوَيْنِ

অর্থাৎ কুরবানীর প্রবাহিত রক্ত আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু’টি কুচকুঁচে কালো ছাগলের চেয়ে অধিক প্রিয়।

 [সুনান বায়হাকী ]

 কুরবানী করার পদ্ধতি : 

উট দাঁড়ানো অবস্থায় এরহলক্বূমবা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তেবিসমিল্লা-হি আল্লাহু আকবারবলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করেনহরকরতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলেযবহকরতে হয়।

সুবুলুস সালাম, ৪/১৭৭ পৃঃ; মির‘আত ২/৩৫১; , ৫/৭৫ প্রভৃতি।

কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। সময় রাসূলুল্লাহ সা. নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন। রাসূলুল্লাহ সা. নিজ হাতে যবহ করেছেন। অন্যের দ্বারা যবহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম। ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিন দিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে।

ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃঃ।

অনেক ছাহাবী বিদ্বানগণ ১৩ তারিখেও জায়েয বলেছেন।

মির‘আত ৫/১০৬-১০৯।

যবহকালীন দো :

. বিসমিল্লা-হি আল্লা-হু আকবার

অর্থ: আল্লাহর নামে, আল্লাহ সর্বোচ্চ।

 . বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী

(আল্লাহর নামে, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ হ’তে)।

এখানে কুরবানী অন্যের লে তার নাম মুখে বলবেন অথবা মনে মনে নিয়ত করে বলবেন, ‘বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন ফুলান ওয়া মিন আহলে বায়তিহী’ (...অমুকের তার পরিবারের পক্ষ তে)

এই সময় দরূদ পাঠ করা মাকরূহ

মির‘আত ২/৩৫০ পৃঃ; , ৫/৭৪ পৃঃ।

যদি দো ভুলে যান বা ভুল হবার ভয় থাকে, তবে শুধুবিসমিল্লাহবলে মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে।

ইবনু কুদামা, আল-মুগনী (বৈরূত ছাপা : তারিখ বিহীন), ১১/১১৭ পৃঃ।

 ঈদের ছালাত খুৎবা শেষ হওয়ার পূর্বে কুরবানী করা নিষেধ। করলে তাকে তদস্থলে আরেকটি কুরবানী দিতে হবে।

মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৭২; মুসলিম, নায়ল ৬/২৪৮-২৪৯ পৃঃ।

কুরবানী আক্বিকাহ একত্রে করা:

কুরবানী আক্বীক্বাহ দুটিরই উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করাএই (ইসতিহসানের) যুক্তি দেখিয়ে কোন কোন বিদ্বান  কুরবানীর গরু  বা  উটে  এক বা একাধিক সন্তানের আক্বীক্বা সিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন (যা এদেশে অনেকের মধ্যে চালু আছে)

বুরহানুদ্দীন মারগীনানী, হেদায়া (দিল্লী : ১৩৫৮ হিঃ) ‘কুরবানী’ অধ্যায় ৪/৪৩৩; আশরাফ আলী থানভী, বেহেশতী জেওর (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১০ম মুদ্রণ ১৯৯০) ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায়  ১/৩০০ পৃঃ।

হানাফী মাযহাবের স্তম্ভ বলে খ্যাত ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এই মতের বিরোধিতা করেন। ইমাম শাওকানী রহ. এর ঘোর প্রতিবাদ করে বলেন, এটি শরীআত, এখানে সুনির্দিষ্ট দলীল ব্যতীত কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

নায়লুল আওত্বার, ‘আক্বীক্বা’  অধ্যায় ৬/২৬৮ পৃঃ।

গোশত বণ্টন :  

কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজ পরিবারের খাওয়ার জন্য, এক ভাগ প্রতিবেশী যারা কুরবানী করতে পারেনি তাদের জন্য এক ভাগ সায়েল ফক্বীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করবে। প্রয়োজনে উক্ত বণ্টনে কমবেশী করায় কোন দোষ নেই।

মির‘আত ৫/১২০।

কুরবানীর গোশত যত দিন খুশী রেখে খাওয়া যায়।

তিরমিযী হা/১৫১০; আহমাদ হা/২৬৪৫৮ সনদ হাসান।

 অমুসলিম দরিদ্র প্রতিবেশীকেও দেওয়া যায়।

আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১২৮।

পারিশ্রমিক দেয়া:

কুরবানীর পশু যবহ করা কিংবা কুটা-বাছা বাবদ কুরবানীর গোশত বা চামড়ার পয়সা তে কোনরূপ মজুরী দেওয়া যাবে না। ছাহাবীগণ নিজ নিজ পকেট থেকে এই মজুরী দিতেন। অবশ্য ব্যক্তি দরিদ্র লে হাদিয়া স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়ায় দোষ নেই।

আল-মুগনী, ১১/১১০ পৃঃ।

ঈদগাহে যাওয়ার সময়:

রাসূলুল্লাহ সা. ঈদুল ফিৎরের দিন কয়েকটি বেজোড় খেজুর খেয়ে ঈদগাহে বের তেন এবং ঈদুল আযহার দিন ছালাত আদায় না করা পর্যন্ত কিছুই খেতেন না।

বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩৩;  তিরমিযী, মিশকাত, হা/১৪৪০ সনদ ছহীহ।

 তিনি কুরবানীর পশুর গোশত দ্বারা ইফতার করতেন।

আহমাদ হা/২৩০৩৪, সনদ হাসান; নায়লুল আওত্বার ৪/২৪১।


বর্জনীয় কাজসমূহ

কুরবানী কেন্দ্রিক:

. কুরবানী করতে হবে আল্লাহর নামে কুরবানীর দাতার পক্ষ থেকে

. কুরবানী পশুর প্রাণ বের হওয়ার পূর্বেই চামড়া না ছোলা

. কুরবানী যবেহ করার সময় অন্য পশু বা কুরবানীর পশুকে পাশে না রাখা

. যবেহ করার পর দ্রুত প্রাণ বের করার জন্য ছুরি দ্বারা গলায় আঘাত না করা

৫. যবেহ করার জন্য ছুরীতে ভালোভাবে ধাঁর করে নেয়া যাতে হালকা চাপ দিলেই দ্রুত কেটে যায়। এতে প্রাণীর কষ্ট কম হবে। হাদীসে এমনটিই বলা হয়েছে। 

বিনোদন কেন্দ্রিক:

. বিধর্মীদের সংস্কৃতি চর্চা না করা  পোষাক চালচলনে তাদের অনুসরণ না করা কারণ রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের ( বিধর্মীদের ) সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে তাদেরই অন্তভূক্ত ( দলভূক্ত হবে কিয়ামতের দিন )

. গান-বাজনা না করা না শোনা এটা শয়তানের কাজ যা একজন মুসলিম কখনো করতে পারে

. রাস্তা-ঘাটে অযথা জনজমায়েত না করা, যাতে পথচারীর কষ্ট হয়

. শরিয়ত বিরোধী কোন প্রকার খেলা বা বিনোদনের ব্যবস্থা না করা বা অংশগ্রহণ না করা

 অন্যায় কাজের সূচনা তাতে অংশগ্রহণকারী সমপরিমাণ গোনাহগার হবে

মনে রাখতে হবে যে, কুরবানী আল্লাহ প্রদত্ত ইবাদত এতে অফুরন্ত সোয়াব অর্জনের সুযোগ রয়েছে কোনভাবেই যেনো আমাদের দ্বারা গোনাহের কাজ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল প্রকার অন্যায় ও গর্হিত কাজে থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন।

আমিন।

সংকলনে,

এইচ.এম. হুজ্জাতুল্লাহ

বি.টিআই. এস      এম. টি. আই. এস.

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। 


No comments

Powered by Blogger.