কবি মাহমুদ দারবিশ এর জীবনী




কবি মাহমুদ দারবিশ এর জীবনী

যুগে যুগে পৃথিবীর প্রতিটি সংগ্রাম সফলতার পিছনে রয়েছে একঝাঁক কলম যোদ্ধাদের বিশেষ অবদান যারা আড়াল থেকে জনগণকে শক্তি প্রেরণা দিয়ে থাকেন 

মাহমুদ দারবিশ ছিলেন তাদেরই একজন তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি  যার লেখা কবিতা হাজারো মুক্তিকামী ফিলিস্তিনির হৃদয় নিংড়ানো আবেগ। তার কবিতার একেকটি লাইন যেন দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইস্পাত-দৃঢ় প্রাচীর। যিনি বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ কিছু মুক্তিকামী মানুষের অসহায় আর্তনাদ।

নিম্নে কবির সংক্ষীপ্ত  জীবনবৃত্তান্ত  উল্লেখ করা হল-

নাম:

কবির নাম মাহমুদ দারবিশ তাঁর  পিতার নাম সালীম, মাতার নাম আল-হাজজা হুরিয়াহ তাঁর পিতামহ হুসাইন দারবিশ মাতা-পিতার পাঁচ পুত্র তিন কন্যার মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ছিলেন

জন্ম:

কবি ১৩ই মার্চ ১৯৪১ সালে আল বিরওয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন গ্রামটি উত্তর ইসরাইলের পশ্চিম গ্যালিলি অঞ্চলে আক্কা উপকূলের ১২. কি.মি পূর্বে অবস্থিত  ১৯৪৮ সালে গ্রামটি ইসরাইলী সৈন্যরা দখল করে নেয় এবং ১৯৫০ সালে নাম পরিবর্তন করে আহিহুদ রাখে বর্তমানে এনামেই গ্রামটি পরিচিত

শিক্ষা জীবন:

 দারবিশের পড়াশোনা শুরু হয় প্রথমে বাড়িতে, পিতামহের নিকট কবির হাতেখড়ি তাঁর নিকট থেকে ছোটবেলায় অনেক প্রাচীন আরবী কবিতা মুখস্ত করেন

আল বিরওয়া উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আল জাদীদা গ্রামে আত্মগোপন করে দায়রুল আসাদ নামক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন  আল জাদীদা গ্রামের উত্তরে অবস্থিত কাফার ইয়াসীফ গ্রামে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন

কবির ইচ্ছা:

মাহমুদ দারবিশকে ছোটবেলায় একদিন তাঁর দাদা জিজ্ঞাসা করেছিলেন  বড় হয়ে তুমি কি হবে ?

তিনি বলেছিলেন, “আমার ইচ্ছা আমি বড় হয়ে কবি হবো এবং মুয়াল্লাকার মত অনেক দীর্ঘ কবিতা লিখবো উল্লেখ্য  কবি ছোটবেলায় দাদার নিকট থেকে আরবি কবিতা মুখস্ত করতেন

শরণার্থী জীবন:

১৯৪৮ সাল মাহমুদ দারবিশের বয়স তখন ছয় বছর। আল-বিরওয়াতে জন্ম, এ গ্রামেই বেড়ে ওঠা। আকস্মিক ইহুদি আক্রমণের আগে কোনোদিন কল্পনাও করেননি নিজেদের পৈত্রিক ভিটেমাটি এভাবে কেউ দখল করে নেবে। যে রাতে ইসরায়েলি বাহিনী অ্যাকারে হামলা চালায়, সে রাতেই দারবিশের পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী দেশে। রাতভর দুর্গম পথ পেরিয়ে ভোরে পৌঁছায় লেবাননে। আশ্রয় মেলে সেখানকার এক শরণার্থী শিবিরে।

 ১৯৪৯ সালে আল বিরওয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আল জাদীদা গ্রামে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আশ্রয় নেন

রাজনীতিতে যোগদান:

মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষে মাহমুদ দারবিশ ইসরাইলী কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগদান করেন ১৯৭৩ সালে তিনি ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থা ( PLO ) যোগদান করেন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেন এবং ইয়াসির আরাফাতের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে দায়িক্ত পালন করেন ১৯৯৩ সালে আসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তিনি এটা প্রহশনের চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে PLO এর সকল স্তর থেকে পদত্যাগ করেন

ব্যক্তিগত জীবন:

ফিলিস্তিন ছেড়ে আসার পর মস্কো, কায়রো, বৈরুত, দামেস্ক, তিউনিসিয়া, প্যারিসসহ আরো বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটিয়েছেন জীবনের পুরোটা সময়। 

বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ালেও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের সাথে। জনসমাগম পছন্দ করতেন না। একা একাই থাকতেন পছন্দ করতেন। বিয়ে করেছিলেন দু'দুবার, কিন্তু সংসার করা হয়নি। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই বিচ্ছেদ হয়। ফলে, কবি নি:সন্তান ছিলেন

ব্যক্তিগত জীবনে বেশ নিয়ম মেনে চলা মানুষই ছিলেন। বেশি রাত জাগার অভ্যাস ছিল না, ঘুম থেকেও উঠতেন সকাল সকাল। মনে হাজারো আক্ষেপ, যন্ত্রণা থাকলেও শারিরীকভাবে ছিলেন সুস্থ। উল্লেখযোগ্য রোগব্যাধি বলতে ছিল এক হার্টের সমস্যা, যা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেষ জীবনে।

লেখনী প্রকাশ:

 কবি মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষে ইসরাইলী কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগদানের পর পার্টির মূখপাত্র আল ইত্তিহাদ আল জাদীদ পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা প্রবন্ধ লিখতেন এভাবে তাঁর লেখনী বিভিন্ন মাসিক ত্রৈমাসিক পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে

পত্রিকা সম্পাদনা:

 মাহমুদ দারবিশ অনেকগুলো পত্রিকা সম্পাদনা করেন নিম্নে তার বর্ণনা দেয়া হল-

ইসরাইলী কমিউনিষ্ট পার্টির মূখপাত্র আল ইত্তিহাদ,আল জাদীদ,আল ফাজর সম্পাদনা করেন ১৯৭২ সালে  আল আহরাম পত্রিকায় কাজ করেন ১৯৭৩ সালে বৈরুতে শুউন ফিলিসতীনিয়্যাহ নামক ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন বৈরুতে 'প্যালেস্টাইন অ্যাফেয়ার' জার্নালের সম্পাদনা করেন  ১৯৮১ সালে আল কারমাল নামে একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা বের করেন যা আরব সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে

কবিতার মাধ্যমে মুক্তিসেনাদের প্রেরণা:

তিনি কবিতা প্রবন্ধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনী  মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকেন তিনিআমসিয়াবা সান্ধ্যকালীন কবিতা পাঠের আসর প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর আসর দ্বারা ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী জনগণ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল ইসরাইলী সরকার তাঁর একর্মকান্ডে শঙ্কিত হয়ে সান্ধ্যকালীন কবিতা পাঠের আসরের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দশটি বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েহাইফা বাস করতে বাধ্য করে  তবুও তারা কবির স্বদেশ প্রেম মুক্তিকামীদের সহযোগীতার পথে বাধা হতে পারেনি

কারাবরণ:

ইসরাইলী সরকারের বিভিন্ন রকম যুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও কবি তাঁর কবিতা প্রবন্ধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনী জনগণকে প্রভাবিত করতে থাকেন ফলে ইসরাইলে সরকার তাঁকে ( ১৯৬১,১৯৬৫,১৯৬৬,১৯৬৭ ১৯৬৯ সালে ) পাঁচবার কারাগারে প্রেরণ করে

রোগ-ব্যাধী:

কবি হ্রদরোগে আক্রান্ত ছিলেন ১৯৮৪ ১৯৯৮ সালে দুবার তাঁর হার্টে অপারেশন করা হয়েছিল ২০০৮ সালে তাঁর আবার অসুস্থতা বৃদ্ধি পায় ফলে, ২০০৮ সালের আগষ্ট আমেরিকার টেক্সাসের হাউস্টনে হেরমান মেমোরিয়াল হাসপাতালে তৃতীবার তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারী করা হয়

মৃত্যুবরণ:

২০০৮ সালের আগষ্ট তৃতীবারের মত তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারী করা হয় তিন দিন অজ্ঞান থাকার পর আগষ্ট ২০০৮ তিনি মৃত্যুবরণ করেন মৃত্যু সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর

কবির মৃত্যুতে শোক:

কবির মৃত্যুতে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী জনগণ বিমর্ষ হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও জানাযায় অংশগ্রহণ করেন তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়  কবিকে রামাল্লা প্রাসাদে দাফন করা হয় 

পুরস্কার সমূহ:

কবি মাহমুদ দারবিশ তাঁর লেখনি শুধু ফিলিস্তিনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময় ফলে,বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সংস্থা কবিকে পুরস্কারে ভূষিত করেছেন তবে তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার তার প্রতি ফিলিস্তিনীদের ভালবাসা। নিম্নে তার কিছু নমুনা উল্লেখ করা হল-

.- বিভিন্ন রাষ্ট্রকর্তৃক প্রাপ্ত পুরস্কার

ক্রমিক

নং

পুরস্কারের নাম

দেশের নাম

সাল

.

লেনিন শান্তি পুরস্কার

সোভিয়েত ইউনিয়ন

১৯৮৩

.

ফ্রান্সের সর্বোচ্চ চারুকারু পুরস্কার 

ফ্রান্স

১৯৯৭

.

মেডিটেরিয়ান পুরস্কার

ইতালি

১৯৮০

.

ইবনে সীনা পুরস্কার

রাশিয়া

১৯৮১

.

সুলতান বিন আলী আল ওয়াইস পুরস্কার

দুবাই

২০০৩

                                                    .-সংস্থা বা অন্যান্য কর্তৃক প্রাপ্ত পুরস্কার

ক্রমিক

নং

পুরস্কারের নাম

সাল

.

আফ্রো-এশিয়ান লেখক সংঘ কর্তৃক লোটাস পুরস্কার

১৯৬৯

.

প্রিন্স স্যান্টাক্লজ পুরস্কার

২০০৪

.

কালচারাল ফ্রিডম ল্যানিন ফাউন্ডেশন পুরস্কার

২০০১

.

ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর এ্যারাবিক পয়েট্রি পুরস্কার

২০০৭

.

গোল্ডেন রেথ অফ স্ট্রাগা পয়েট্রি ইভেনিং পুরস্কার

২০০৭

গ্রন্থাবলি:

কবি মাহমুদ দারবিশ অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন যা বিশ্বের দরবারে তাঁকে চিরঅমর করে রাখবে

.- কবির প্রকাশিত বিখ্যাত কবিতা সাহিত্যকর্মসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হল-

ক্রমিক নং

নাম

প্রকাশকাল

.

ডানাহীন পাখি ( আসাফীর বিলা আজনিহা )

১৯৬০

.

জলপাই পাতা ( আওরাকুয যাইতুন )

১৯৬৪

.

ফিলিস্তিনের এক প্রেমিক ( আশিক মিন ফিলিস্তিন )

১৯৬৬

.

রাতের শেষ প্রহর ( আখিরুল লাইল )

১৯৬৭

.

আহমাদ আল জাতার ( আহমাদ আল জাতার )

১৯৭৬

.

আমার প্রেয়সীর নিদ্রাচ্যুতি ( হাবিবাতী তানাহাদু মিন নাউমিকা )

১৯৬৯

.

কণে ( আল আরায়িস )

১৯৭৭

.

দেয়ালিকা ( আল জিদারিয়াহ )

২০০০

মাহমুদ দারবিশের সংকলন ( দীওয়ানু মাহমুদ দারবিশ )

১৯৯৪

১০.

আমি নিম্নস্বাক্ষরকারী ( আনা আল মুয়াক্কি আদনাহু )

২০১৪

১১.

গালিলে পাখিগুলো মরছে ( আসাফির তামাতু ফিল জালীল )

১৯৭১

১২

বন্দুকের আলোকে লেখা ( আল কিতাবা আলা দাউয়িল বান্দুকিয়াহ )

১৯৭০

১৩

দূর শরতের আলকা বৃষ্টি ( মাতার নায়িম ফি খারীফ বাইদ )

১৯৭১

১৪

তোমাকে ভালোবাসি কিংবা ভালোবাসি না ( ইউহিব্বুকি আও লা ইউহিব্বুকি )

১৯৭২

১৫

একজন সৈন্যের চোখে শ্বেতপদ্মের  স্বপ্ন ( জনুদিউন ইহলুমু বিল যানাবিক আল বাইদা )

১৯৭৩

১৬

বৈরূতের কবিতা ( কাসিদাতু বাইরূত )

১৯৮২

১৭

নম্বর প্রচেষ্টা ( মুহাওয়ালা রাকাম )

১৯৭৪

১৮

উচু ছায়ার স্তুতি ( মাদীহুয যিল্লিল আলী ) 

১৯৮৩

১৯

স্বল্প গোলাপ ( ওয়ারদ আকাল্ল )

১৯৮৫

২০

আমার কাংখিত বস্তু দেখছি ( আরা মা উরীদ )

১৯৯০

২১

এগারোটি নক্ষত্র ( আহাদা আশারা কাওকাবান )

১৯৯২

২২

অপরিচিতির পালঙ্ক ( সারীর আল গারীবা )

১৯৯৩

২৩

কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেও না ( লা তাতাযিরআম্মা ফা আলতা )

২০০৩

.- কবির গদ্য সাহিত্য কর্মসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হল-

ক্রমিক নং

গদ্যের নাম

প্রকাশকাল

মাতৃভূমি প্রসঙ্গে কিছু ( শাইয়ুনআনিল ওয়াতান ) 

১৯৭১

সাধারণ দু:খের ডায়রী ( ইয়াউমিয়াত আল হুযন আলআদী )

১৯৭৩

ভুলে যাওয়ার স্মৃতি ( যাকিরাহ লিন নিসয়ান )

১৯৯৫

অনুপস্থিতির উপস্থিতি ( ফী হাদরাতিল গিয়াব )

২০০৬

আমাদের অবস্থার বিবরণ ( ফী ওয়াসফ হালাতিনা )

১৯৮৭

চিঠিপত্র  ( আর রাসাইল )

১৯৯০

 

     মাহমুদ দারবিশ একটি নাম ,একটি ইতিহাস তিনি  ১৯৪৮ সালে ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জনগণকে কবিতা লেখনীর মাধ্যমে প্রভাবিত করেছেন আগ্রাসী শক্তির শত নির্যাতন তাঁর কলমকে দমন করতে পারেনি যিনি হাজারো বছর ধরে ফিলিস্তিনী জনগণের হ্রদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জালেমের বিরুদ্ধে মাজলুমের শক্তির প্রতীক হিসেবে

কবি বলেছেন, ‘মানুষ বেচে থাকে তাঁর কর্মে

 


No comments

Powered by Blogger.